১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনীদের বাস্তুচ্যুতি, জমি দখল, বসতি স্থাপন এবং লাগাতার আগ্রাসনের শিকার হতে হয়েছে। গত ৭৫ বছরে তারা হারিয়েছে তাদের ভূখণ্ড, কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের ঘরবাড়ি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এমনকি বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারও। এরপরও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিটি দীর্ঘদিনের। ইতোমধ্যে ১৫০টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সর্বশেষ যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালের সিদ্ধান্তে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫১-এ। এ স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিনী জনগণের মুক্তি সংগ্রামের জন্য একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। বাংলাদেশও এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে এবং যথার্থই বলেছে-এটি স্বাধীনতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
তবে বাস্তবতা এখনো নির্মম। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনী জনগণ ইসরাইলী দখল, আগ্রাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে আসছে। গাজায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, প্রতিদিনের বিমান হামলা এবং পশ্চিম তীরে ইসরাইলী বসতি স্থাপনের মাধ্যমে দখলদারিত্ব চলছেই। প্রশ্ন জাগেÑস্বীকৃতি দিয়ে কী হবে, যদি মাটিতে ফিলিস্তিন নামে টিকে থাকার মতো কোনো ভূখণ্ডই কার্যত অবশিষ্ট না থাকে? গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, পশ্চিম তীরের ভেতর প্রতিরোধের শক্তিও কার্যকরভাবে নিস্তেজ করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম তীরের ভেতর সামান্য জমিও এখন নিরাপদ নয়, কারণ সেখানেও চলছে অবৈধ বসতি স্থাপন ও দমনপীড়ন। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন-যখন ফিলিস্তিন নামে কার্যত কোনো ভূখণ্ডই নেই, তখন এ স্বীকৃতির প্রকৃত উপযোগিতা কোথায়? এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইসরাইলকে বিপুল পরিমাণ মারণাস্ত্র সরবরাহ করছে, যা গণহত্যাকে আরও তীব্র করছে।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধিতা করেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প খোলাখুলি বলেছেন, এ বিষয়ে তার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের মতো দেশের মতানৈক্য রয়েছে। বর্তমান প্রশাসনের শীর্ষ কূটনীতিকেরা প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেনÑস্বীকৃতির উদ্যোগ কেবল হামাসকে শক্তিশালী করবে কিংবা ইসরাইলকে প্ররোচিত করবে পশ্চিম তীরকে আরও আলাদা করার। অর্থাৎ ওয়াশিংটনের অবস্থান স্পষ্ট: তারা ইসরাইলের দখলদারিত্বের পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে, আর ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ বিপরীতে। ওয়াশিংটন একদিকে স্বীকৃতির বিরোধিতা করছে, অন্যদিকে ইসরাইলকে অবিরাম সামরিক সহায়তা দিচ্ছেÑযে অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে গাজার সাধারণ মানুষ হত্যায়।
তবুও যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা অন্য দেশগুলোকে থামাতে পারেনি। যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালের মতো দেশের এ সাহসী পদক্ষেপ নতুন এক ধাপ উন্মোচন করেছে। রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপের শক্তিধর দেশ ও জাতিসঙ্ঘের ভেটো ক্ষমতাধর ফ্রান্স। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি চারটি ভেটো ক্ষমতাধর দেশেরই স্বীকৃতি পেলো ফিলিস্তিন। সোমবার বিশেষ জাতিসঙ্ঘ সম্মেলনে এক ভাষণে এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির কথা জানান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। ফ্রান্সের সাথে এদিন আরো স্বীকৃতি দিয়েছে বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মালটা, মোনাকো ও আনদোরা। তবে এও মনে রাখা জরুরি, স্বীকৃতি এক বিষয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকা আরেকটি বাস্তবতা। স্বীকৃতির রাজনীতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ দখলদারিত্বের অবসান, দমন-পীড়ন ও গণহত্যা বন্ধ হওয়া। যদি আন্তর্জাতিক মহল সত্যিকার অর্থে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে চায়, তবে শুধু স্বীকৃতি নয়-ইসরাইলের আগ্রাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
তবে শুধু স্বীকৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ আছে যেখানে কাগজে-কলমে স্বীকৃতি পাওয়া সত্ত্বেও বাস্তব স্বাধীনতা অধরাই থেকে গেছে। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রেও তাই। যতদিন না দখলদারিত্ব শেষ হচ্ছে, যতদিন না অবরুদ্ধ গাজার মানুষের অবাধ চলাফেরা ও বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আংশিকই থেকে যাবে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কর্তব্য শুধু স্বীকৃতি নয়, বরং ইসরাইলের আগ্রাসন বন্ধে কঠোর চাপ প্রয়োগ, অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা, এবং আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের দায়ে ইসরাইলকে বিচারের মুখোমুখি করা।
গাজার রক্তাক্ত বাস্তবতা এবং পশ্চিম তীরের দমবন্ধ করা জীবনপ্রবাহ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেÑস্বাধীনতা এখনো বহুদূরের পথ। কিন্তু সাম্প্রতিক স্বীকৃতিগুলো নিঃসন্দেহে নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি ন্যায়বিচারের প্রশ্নে দৃঢ় থাকে এবং দ্বিমুখী নীতি পরিহার করে, তবে একদিন হয়তো ফিলিস্তিনের মানুষও প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পাবে।