॥ জিবলু রহমান ॥

এদেশের জনগণ যে সমাজব্যবস্থা ও ধ্যান-ধারণার মধ্যে জীবন যাপন করছিল, যে আদর্শ ও ঐতিহ্য রক্তের শিরায়-উপশিরায় মিশে গিয়েছিল তার নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে ইতিহাসের বই থেকে পুরনো পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে এপার বাংলা-ওপার বাংলা ধ্যান-ধারণা সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হয়।

তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া শত শত কোটি টাকার অস্ত্র। অথচ তাজউদ্দিন আহমদ সংসদে বললেনÑ‘একটি অস্ত্রও সীমান্ত পার করে কেউ নিয়ে যায়নি।’ বাংলাদেশের পাটের দেশে মাড়োয়ারী-মহাজন ও জুটব্যারণদের হাতে তুলে দেওয়া হলো। বাংলাদেশের পাটকলগুলোর যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে ভারতের পাটকলগুলোর শ্রীবৃদ্ধি করা হলো, সীমান্ত খুলে দেওয়া হলো। এভাবে মাত্র পৌঁণে চার বছরে সোনার বাংলার পাঁচ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়! বাংলাদেশকে কাঁচামালের যোগানের একটা উপনিবেশ এবং আরেকটা সিকিম বানাবার সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করা হয়। দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করা হয় স্বাধীনতার পর।

আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৪ সালে প্রথমে কুখ্যাত কালাকানুন বিশেষ ক্ষমতা আইন চালু এবং কিছুদিন পরই জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথ থেকে অনেকটা বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল। এদেশে প্রথম জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। সেটা ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সেসময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চোরাগোপ্তা সহিংসতা বজায় থাকা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীকে অন্যতম দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অবৈধ অর্থনৈতিক তৎপরতা তথা দুর্নীতি ও চোরাচালান রোধে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যখন সংসদে মাত্র কয়েক মিনিটে দেশের নাগরিকদের সকল অধিকার হরণ করে বাকশাল নামক একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।

বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে এক দলীয় শাসন প্রবর্তিত হয়েছিল। মানবিক মর্যাদা, সামাজিক, ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার যে গণতান্ত্রিক লক্ষ্য নিয়ে আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল, তাকে অস্বীকার করে প্রতিষ্ঠা লাভ করে আওয়ামী দুঃশাসনের নরক যন্ত্রণা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবাদর্শের যুপকাষ্ঠে আমাদের জাতিসত্তাকে বলি দেওয়ার আয়োজন প্রায় সম্পন্ন হয়ে এসেছিল।

১৯৭৫ সালের ১৬ জুন দেশের সংবাদপত্র-সাংবাদিকতা তথা বাক-স্বাধীনতা ইতিহাসে কলঙ্কময় এক অধ্যায় সূচিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের প্রথম মাসেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ‘পার্লামেন্টারী ক্যু’ ঘটিয়ে সংবিধানের মৌলিক চেতনা ও প্রকৃত চেহারাটাই বদলিয়ে ফেলা হয়। এ জন্য পাস করা হয়েছিল ৪র্থ সংশোধনী যা গণতন্ত্রিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এভাবে বাকরুদ্ধ ও অসহায় জাতির ঘাড়ে চেপে বসে একদলীয় ব্যবস্থা বাকশালের জগদ্দল পাথর।

শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের ৯৫ শতাংশ নেতা-কর্মী মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদ তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বেতার ভাষণ দেন। মোশতাক যে মন্ত্রীসভা গঠন করেছিলেন তাতে সবাই আওয়ামী লীগের ছিল। ১৫ আগস্ট মোশতাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করে তার নিয়ন্ত্রণে প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রেখেছিলেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ। মোহাম্মদ উল্লাহর পর মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন :

(১) বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী (হাসিনার সময়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হোসেন চৌধুরীর পিতা), (২) অধ্যাপক ইউসুফ আলী, পরিকল্পনা মন্ত্রী, (৩) ফণীভূষণ মজুমদার, স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী, (৪) মো. সোহরাব হোসেন, গণপূর্ত ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী,(৫) আব্দুল মান্নান, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী, (হাসিনার সময়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য), (৬) মনোরঞ্জন ধর, আইন, সংসদীয় ও বিচার মন্ত্রী, (৭) আব্দুল মোমেন, খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রী, (হাসিনার সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা), (৮) আসাদুজ্জামান খান, বন্দর, জাহাজ চলাচল ও নৌ পরিবহন মন্ত্রী, (৯) ড. এ.আর. মল্লিক, অর্থ মন্ত্রী, (১০) ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, শিল্প-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা এবং আণবিক শক্তি মন্ত্রী, (১১) দেওয়ান ফরিদ গাজী, বাণিজ্য, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, (হাসিনার সময় হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা), (১২) অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, শিল্প প্রতিমন্ত্রী, (১৩) শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, বিমান চলাচল, পর্যটন, ভূমি প্রশাসন এবং ভূমি সংস্কার প্রতিমন্ত্রী, (১৪) তাহের উদ্দিন ঠাকুর, তথ্য ও সম্প্রচার, শ্রম, সমাজ কল্যাণ ও সংস্কৃতি এবং ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী, (১৫) মোঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, রেল যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী, (১৬) কে.এম. ওবায়দুর রহমান, ডাক, টেলিফোন ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী।

২০ আগস্ট আরো পাঁচ জন নেতা মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিলেন। তারা হলেন : (১) মোমেন উদ্দিন আহমদ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী, (২) মোসলেম উদ্দিন খান, পাট প্রতিমন্ত্রী, (৩) ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, (৪) রিয়াজ উদ্দিন আহমদ (ভোলা মিয়া), বন, মৎস্য ও পশু সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, (৫) সৈয়দ আলতাফ হোসেন, সড়ক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী।

মোশতাক মন্ত্রীসভায় কোনো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। ঐতিহাসিকভাবে এ কথাই সত্য যে, শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর পর গঠিত সরকার সকল বিচারেই ছিল আওয়ামী-বাকশালী সরকার। মন্ত্রীসভার একজন মাত্র সদস্য তথা প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আলতাফ হোসেন ছিলেন বাকশাল উপলক্ষে বিলুপ্ত রুশপন্থি ন্যাপের নেতা, অন্যদিকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী বাকশাল গঠনের প্রতিবাদে দলত্যাগ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে খন্দকার মোশতাকের একটি বক্তব্যই খুব উল্লেখযোগ্য। ১৯৮৪ সালের ১০ আগস্ট একজন ভারতীয় সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেনÑ‘...দেশকে গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচাবার জন্য আমি ক্ষমতা নিয়েছিলাম। সেদিন তো ফণী বাবুও আমার পাশে ছিলেন...আপনারা দেখেছেন সবই ছিল।’ খন্দকার মোশতাক আরো বলেছেনÑ ‘পার্লামেন্ট থাকার দরুন আমি তিনটার সময় ওথ (শপথ) নিয়েছি। ক্যাবিনেটের অন্য সদস্যরা সাড়ে তিনটায় ওথ নিয়েছেন। সেদিন আওয়ামী লীগ-বাকশালের নির্বাচিত প্রতিনিধি যারা ছিলেন তারাই ওথ নেননি। তিনটার সময় ওথ নেয়ায় দায়িত্বটা আমার ওপর এসে পড়ল, আর যারা সাড়ে তিনটার সময় ওথ নিলেন তাদের কোন দায়-দায়িত্ব নেই না কি?...।’

শেষদিকে খন্দকার মোশতাক বলেছেনÑ‘আমি জাতিকে রক্ষা করেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেতাদের এবং প্রতিনিধিদের বাঁচিয়েছি। ক্ষুব্ধ জনতার ভয়ে একজন লোকও সেদিন প্রকাশ্যে ছিল না। সবাই ইদুরের গর্তে ছিল। (প্রতিপক্ষ) আমার বিরুদ্ধে উল্টো চার্জ (এনেছে যা) আওয়ামী লীগের লোক হওয়ায় আমার মন্ত্রীসভার সবাইকেও আমি আওয়ামী লীগ থেকে নিয়েছিলাম।’ (সূত্র : পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেশে দেশে’, পৃ. ২০২-২০৬)