গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ এখন আর সম্ভাবনার বিষয় নয়, এটি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো এক কণ্ঠে সতর্ক করছেÑযদি অবিলম্বে খাদ্য, চিকিৎসা ও মানবিক সহায়তা প্রবাহ নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে আগামী ৪৮ ঘন্টায় ১৪ হাজারের বেশি শিশু অনাহারে মারা যেতে পারে। এ সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি শিশুই একেকটি জীবন, একেকটি সম্ভাবনা, যা আজ নিঃশেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। দৈনিক সংগ্রামেও এ নিয়ে বুধবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরে হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং বিশ^ ইতিহাসের কালো অধ্যায়। অবরোধ, বিমান হামলা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ, সীমান্তে ত্রাণের দীর্ঘসূত্রতাÑএসব মিলিয়ে গাজা এখন এক আধুনিক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল, ত্রাণ কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বাসাবাড়ি বোমার আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলোÑখাদ্য, পানি ও ওষুধের সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ বা চরমভাবে সীমিত। শিশুদের মতো সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীই এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। এখন তারা ক্ষুধায় কাঁদছে না, বরং নীরবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা বিষয়ক সংস্থা ডঋচ সম্প্রতি জানিয়েছে, গাজার ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ লাখ ইতোমধ্যে চরম খাদ্যঘাটতির শিকার। উত্তর গাজায় পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ, যেখানে শিশুরা খেজুরের আঁশ, পশুর খাদ্য ও এমনকি ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। কিছু এলাকায় দেখা গেছে, শিশুরা মারাত্মক অপুষ্টির শিকার হয়ে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, কিন্তু চিকিৎসা ও খাদ্যের অভাবে তারাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
এমন অবস্থা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার ফল নয়, বরং এটি একটি ইচ্ছাকৃতভাবে চাপিয়ে দেওয়া মানবিক বিপর্যয়। ইসরাইলি বাহিনীর অবরোধ, সীমান্তে ত্রাণবাহী ট্রাক আটকে রাখা, খাদ্যগুদাম ও ত্রাণকেন্দ্রে বোমা হামলাÑএসব পদক্ষেপ কোনোভাবেই আত্মরক্ষার যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, বরং এগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও যুদ্ধ আইনের চরম লঙ্ঘন। গাজায় যা ঘটছে, তাকে দুর্ভিক্ষ বলে সংজ্ঞায়িত করলেও তা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্রায়ণ নয়। এটি একটি মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ-রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পিত একটি ক্ষুধানীতি, যা আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবতার মৌলিক নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। খাদ্য সহায়তা বহনকারী ট্রাক সীমান্তে আটকে রাখা, সরবরাহ গুদামে বিমান হামলা চালানো, চিকিৎসা সরঞ্জাম আটকে দেওয়াÑএসব কার্যকলাপকে আর যাই বলা হোক, যুদ্ধ নয়। এটি গণহত্যার একটি নতুন রূপ যেখানে ক্ষুধা দিয়ে মানুষকে হত্যা করা হয়।
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, প্রতি ১০ মিনিটে গাজায় একটি শিশু মারা যাচ্ছে। এর বেশিরভাগই অপুষ্টি, ডায়রিয়া, ডিহাইড্রেশন ও সংক্রমণজনিত রোগে। চিকিৎসা না পেয়ে এসব শিশুরা ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো বিশ্ব শক্তিগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান ও কার্যত নীরবতা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু ইউরোপীয় দেশ ইসরাইলের পক্ষে এমন এক অন্ধ সমর্থন দেখিয়েছে, যা তাদের মানবাধিকারের রক্ষকের মুখোশ খুলে দিয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলো বারবার ভেটো হয়ে পড়ছে। এমনকি মানবিক যুদ্ধবিরতির বিষয়েও ঐকমত্যে পৌঁছানো যাচ্ছে না।
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক আরব দেশও উদ্বেগজনক নীরবতা পালন করছে। তাদের ব্যবসা, কূটনীতি কিংবা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থ যেন গাজার শিশুদের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, বরং নৈতিক বিপর্যয়। উদ্ভূত, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিবেকবান মানুষ ও রাষ্ট্রগুলোকে এখনই সোচ্চার হতে হবে। কূটনৈতিক চ্যানেলে চাপ তৈরি, আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধের মামলা, অবরোধ ভাঙতে মানবিক করিডোর গঠনÑএসব পদক্ষেপ অবিলম্বে নিতে হবে। গাজার শিশুরা শুধু তাদের খাবারের অধিকার নয়, বেঁচে থাকার ন্যূনতম মানবিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত। এ অবস্থায় বিবেকবান সকল মানুষ, সকল শ্রেণী ও ফোরামের যার যার অবস্থান থেকে গাজার পক্ষে সক্রিয় ও সরব ভূমিকা পালন করার কোনো বিকল্প নেই।