বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৬ জুন এক গভীর কালো অধ্যায়। বাকশালী শাসন ব্যবস্থার অধীনে এদিন চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মানুষের মৌলিক অধিকারÑবক্তব্যের স্বাধীনতা ও তথ্যের অধিকার-এক ঝটকায় কেড়ে নেওয়া হয়। এদিনের ঘটনার আলোকে শুধু গণমাধ্যম নয়, পুরো জাতির স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে একটি ভয়াবহ আঘাত লাগে। এ কালো ইতিহাস ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, বরং বাকশালী ইতিহাসের এ কালো অধ্যায়কে সামনে এনে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সে জন্য নির্দিষ্ট ফোরাম বা প্লাটফর্মে নয়, বরং জাতীয় পরিসরে এই দিবস পালনের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রকৃত ইতিহাস হলো, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ ১৯৭৫ সালের ১৬ জুনের আগেই শুরু হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাকশালী শাসন ব্যবস্থায় গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের সূচনা হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। স্বাধীনতা অর্জনের উচ্ছ্বাস ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া দেশের গণমাধ্যমকে শেখ মুজিবের শাসনব্যবস্থা প্রথম থেকেই বিভিন্ন নিয়ম ও বিধিনিষেধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে, বিশেষ করে ১৯৭৪ সালে যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট বাড়তে থাকে, তখন বাকশালী শাসন ব্যবস্থা গণমাধ্যমকে একঘরে করতে শুরু করে। সত্যি কথা বলার স্বাধীনতা সংকুচিত হয়। পত্রিকা ও প্রকাশনার ওপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপিত হয়। বিরোধী মত বা সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীন সংবাদপত্রগুলো নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়, যাতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত তথ্য ছাড়া অন্য কোনো তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছাতে না পারে।
এমন কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে গণমাধ্যমের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, সাংবাদিকেরা নিপীড়িত হন। আর জনগণ সত্য জানতে বঞ্চিত হয়। এ সময়ের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের পেছনে ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা একচেটিয়া করতে চাওয়ার প্রবণতা, যাতে ক্ষমতার বিরোধিতা বা সমালোচনা রোধ করা যায়। এমতাবস্থায় ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন গণমাধ্যমের ওপর আরেক ধাপের কঠোর দমন শুরু হয়। দেশের প্রায় সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়, মাত্র চারটি পত্রিকা ছাড়া বাকী সবকে নিষিদ্ধ করা হয়। দেশের জনগণের জন্য সংবাদ ও তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার তথা বাক-স্বাধীনতা এবং সংবাদ গ্রহণের অধিকার লঙ্ঘিত হয়।
এ পদক্ষেপ ছিল বাকশালী শাসনের এক ভয়াবহ সংকেত। রাষ্ট্রের স্বার্থে গণমাধ্যমকে একটি সরঞ্জামে পরিণত করা হয়। যারা সরকারের সমালোচনা করত বা স্বতন্ত্র মত প্রকাশ করত, তাদের দমন করা শুরু হয়। সাংবাদিকদের ওপর কঠোর নজরদারি আরোপিত হয়, যারা সরকারের নির্দেশনার বাইরে কাজ করত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ দিনটি আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হারালে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যায়। ১৬ জুনের এ গুমরাহ দিনের পেছনে ক্ষমতা রক্ষার অন্ধ তৎপরতা কাজ করেছিল, যেখানে জনগণের চাওয়াকে উপেক্ষা করে একদলীয় শাসনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছিল। ১৯৭৫ সালের এ কালো অধ্যায়ের ধারাবাহিকতায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারও ঠুনকো সব অজুহাতে অনেকগুলো টেলিভিশন, পত্রিকা ও নিউজ আউটলেট বন্ধ করে দিয়েছিল। আওয়ামী আমলে সাংবাদিক নির্যাতনের রেকর্ড অতীতের অন্য সব আমলকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এতকিছুর পরও অনেক মূলধারার পত্রিকা ও গণমাধ্যম ১৬ জুনের এ কলঙ্কিত দিনকে এড়িয়ে যায়। এর পেছনে রয়েছে বাকশালী শাসনের প্রতি এক ধরনের দরদ ও তাদের ইতিবাচক ইমেজ তৈরির চেষ্টা। যারা ক্ষমতার কুশাসনে চোখ বুঁজে থাকে, তারা ইতিহাসের কাঁটা ভুলে যেতে চায়। কিন্তু ভুল ইতিহাস সমাজকে বিভ্রান্ত করে, জাতিকে পিছিয়ে দেয়। গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো ইতিহাসের সত্য উন্মোচন করা এবং অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া। ইতিহাস লুকিয়ে রাখার মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বরং আমাদের এ কালো অধ্যায়কে সামনে এনে তার থেকে শিক্ষা নিতে হবে যাতে কখনোই আর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন না হয়। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। সংবাদ প্রকাশে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা বা সেন্সরশিপ ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া আর কিছু নয়। তাই সাংবাদিক সমাজের সক্ষমতা বাড়ানো, স্বাধীন সংগঠন গড়ে তোলা ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। এ প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ভবিষ্যতে এ কালো দিবসটি যেন কোনো দলীয় বা ফোরামের ব্যানারে না হয়ে জাতীয় পরিসরে আয়োজন করা হয়; এ লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ তারা নিশ্চয়ই গ্রহণ করবেন।