গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত অভ্যুত্থানেই ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। বিপ্লব পরবর্তী এ সরকারের কাছে ভিকটিম পরিবারগুলোসহ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের প্রধান ও প্রথম দাবি ছিল ফ্যাসিবাদী আমলে সংঘটিত গণহত্যা ও গুম খুনের বিচার। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন চলাকালে শুধুমাত্র দু’মাসেই আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের হাতে নিহত হয়েছে ১৫শ’র বেশি মানুষ। আহত হয়েছে ২৪ হাজারের বেশি। আহতদের অনেকেই এখনো প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণা ও অঙ্গহানি নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকার গঠনের পর ৮ মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এখনো এসব গণহত্যার বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি, এবং দোষীদের শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা হয়নি। আইনী প্রক্রিয়া তাড়াহুড়ো করে হয় না এবং হওয়া উচিতও নয়। তারপরও সচেতন দেশবাসী মনে করেন, বিচার করার ক্ষেত্রে অন্তত যে অগ্রগতিগুলো দৃশ্যমান হওয়ার কথা ছিল বাস্তবে তা হয়নি। ফ্যাসিবাদের মূল হোতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকেও বিদেশের মাটি থেকে ফিরিয়ে আনা যায়নি। যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও এখনো পর্যন্ত অভিযোগপত্র দেয়া যায়নি। উল্টো আদালতে আসা-যাওয়ার পথে আসামীদের দম্ভোক্তি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ জনগণকে বিস্মিত করছে প্রতিনিয়তই।

গণহত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করার সময় হ্যান্ডকাফ পরানো নিয়ে সর্বশেষ গত রোববারও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান এবং জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের বাগবিতণ্ডা হয়েছে। প্রিজন ভ্যান থেকে নামানোর সময় আসামীরা তাদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দেন এবং দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। একজন পুলিশ সদস্য অভিযোগ করে আর জানান, হাসানুল হক ইনু পুলিশ সদস্যদের ‘তোদের চৌদ্দ গোষ্ঠী খেয়ে ফেলব’ বলে হুমকি দেন এবং হাজতখানায় এসে মিটিং করে পুনরায় হুমকি দেন। আর শাজাহান খান প্রিজনভ্যান থেকে নামার সময় ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের মাথার হেলমেট ছুঁড়ে মারেন। এমনকি শাসিয়েছেন পুলিশকেও। জানা গেছে, ট্রাইব্যুনালের হাজতে নেওয়ার সময় শাজাহান খানকে হাতকড়া পরাতে যান দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। দৃশ্যগুলো ভিডিওর মাধ্যমেও দেশবাসী অবলোকন করেছে। বস্তুত এখনো পর্যন্ত বন্দী আওয়ামী লীগের কোনো নেতার কন্ঠে বা আচরণে কিংবা বিদেশের মাটিতে বসে দেয়া দলীয় সভানেত্রীর বক্তব্যে সংঘটিত গণহত্যার জন্য কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করতেও দেখা যায়নি।

অথচ স্পষ্টত যে ভয়াবহ গণহত্যা বাংলাদেশে হয়ে গেলো তার দায়ে অভিযুক্ত আসামীদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা দেয়া যায়নি। সর্বশেষ সংবাদ হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সংঘটিত গুম-খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানসহ ১১ আসামীর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় আরও দু’মাস বাড়ানো হয়েছে। আগামী ২৪ জুন এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় নির্ধারণ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশন দাবি করছেন, গুমের কাজ গোপনে করা হতো তাই এসব বিষয়ে তদন্ত করতেও সময় লাগছে। আর এ গ্রাউণ্ডেই তারা দু’মাস সময় বৃদ্ধির আবেদন করেছেন আর আদালতও তা মঞ্জুর করেছেন। নিঃসন্দেহে এ ধরনের সংবাদগুলো ভিকটিম ও বিচার প্রত্যাশী মানুষগুলোকে হতাশ করবে। যদিও একটি আশার সংবাদও প্রসিকিউশন দিয়েছেন। সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে, শুধুমাত্র জুলাই-আগস্টে বৈষম‍্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে যে গণহত্যা হয়েছে এর তদন্ত কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। এই গণহত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বহুল প্রত্যাশিত তদন্ত প্রতিবেদন যেকোনো সময় তারা দাখিল করবেন।

আরেকটি সুসংবাদ হলো, ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবে গণহত্যার প্রথম পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা রাজধানীর চাঁনখারপুলে সংঘটিত গণহত্যার প্রথম মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ৮ জন পুলিশ সদস্যকে অভিযুক্ত করেছে। এ ঘটনায় ৬ জন নিহত হয়েছেন। শিগগিরই ট্রাইব্যুনাল এ মামলার ফরমাল চার্জ গঠন করে ট্রায়াল শুরু করবে বলেও জানা গেছে। আমরা আশা করবো, অভিযুক্ত আসামীদের দম্ভোক্তিপূর্ণ আচরণ সংযত করণে এবং সর্বোপরি জুলাই আগস্টের বিপ্লবের গণহত্যার প্রকৃত কুশীলবদের দ্রুত ও ন্যায্য বিচার নিশ্চিতে অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।