বন্ধুপ্রতীম কোন কোন দেশ থেকে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পেলেও তা কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখিকরণের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। অর্থনীতিবিদগণ অনেকদিন ধরেই রপ্তানি পণ্যের ভিন্নমুখিতা আনায়নের পরামর্শ দিলেও কর্তৃপক্ষ সে ব্যাপারে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দ্বিপাক্ষিক সুসস্পর্কের ইস্যুটি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। গত শতাব্দির আশির দশক থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য অতিমাত্রায় তৈরি পোশাক নির্ভর হয়ে পড়ে। বর্তমানে রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসছে তৈরি পোশাক পণ্য থেকে। কোন কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ধস নামলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্থানীয় পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখিকরণের পাশাপাশি তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে গুণগত মান সম্পন্ন পণ্যের যোগান নিশ্চিত করতে হয়। যেমন যে দেশটি ভোক্তাদের চাল প্রয়োজন সে দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানির চেষ্টা করলে কোন লাভ হবে না বরং যে দেশ চাল রপ্তানি করে সেই দেশই সংশ্লিষ্ট চাল আমদানিকারক দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে পারবে। আগের দিনে যখন পণ্য বিনিময় প্রথা প্রচলিত ছিল তখন চাহিদাকৃত পণ্যের মিল খুঁজে বের করতে হতো। পণ্যের বিনিময় হত পণ্যের সঙ্গে। যেমন যে ব্যক্তি উদ্বৃত্ত চাল আছে কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ কাপড় নেই তিনি চেষ্টা করতেন এমন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার জন্য যিনি কাপড়ের বিনিময়ে চাল ক্রয় করতে চান। এ ধরনের দু’জন ব্যক্তির মধ্যে পণ্য বিনিময় হতো। বর্তমানে যে বাণিজ্য হয় তাও ঠিক পণ্য বিনিময় প্রথার মতোই। ভিন্নতা শুধু আগের পণ্যের বিনিময়ে পণ্য ক্রয় করা হতো। আর এখন অর্থের বিনিময়ে পণ্য ক্রয় করা হয়। চাহিদা সূত্র আগের মতোই রয়েছে। যেমন চীন বাংলাদেশের বন্ধু প্রতীম একটি দেশ। তারা বাংলাদেশি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। কিন্তু সে সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। কারণ চীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সবার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশও মূলত তৈরি পোশাকই রপ্তানি করে। ফলে চীনের বাজারে আমরা প্রবেশ করতে পারছি না।

এ জন্য চীন দায়ি নয়, দায়ি আমাদের নীতি-কৌশল। বাংলাদেশ যদি তৈরি পোশাকের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করতে পারতো তাহলে খুব সহজেই চীনের বাজার দখল করতে পারতো। চীন থেকে বাংলাদেশ তার আমদানি পণ্যের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ক্রয় করে থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশ তার রপ্তানি পণ্যের মাত্র ১ দশমিক ২২ শতাংশ চীনে রপ্তানি করে। ভারতের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ভারত আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। যেহেতু ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়েই তৈরি পোশাক রপ্তানি করে তাই এ দু’টি দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ খুবই কম। আমরা যদি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাই তাহলে রপ্তানি পণ্যের ভিন্নমুখিতা সৃষ্টি ছাড়া কোন বিকল্প নেই। রপ্তানি পণ্যের ভিন্নমুখিতা আনায়নে ব্যর্থতার পাশাপাশি আমরা সম্ভাবনাময় নতুন রপ্তানি গন্তব্য খুঁজে বের করতে পারছি না। বাংলাদেশ অন্তত দেড় শত দেশে পণ্য রপ্তানি করে। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশের মতো।

বাংলাদেশ চীন ও ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে। কিন্তু এ দু’টি দেশে বাংলাদেশের রপ্তানির হার বা পরিমাণ খুবই কম। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখিকরণে ব্যর্থতার পাশাপাশি ভারত নানা ধরনের অশুল্ক বাধা সৃষ্টি করে সে দেশের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করছে। যেসব দেশ থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করি সেসব দেশ আমাদের পণ্য আগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমদানি করবে এমন শর্তারোপ করা যেতে পারে। তাহলে তারা বাংলাদেশি পণ্য বেশি বেশি পরিমাণে আমদানি করতে বাধ্য হবে। তবে সবার আগে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য তালিকা বহুমুখিকরণ করতে হবে। শুধু তৈরি পোশাক নিয়ে বিশ্ববাজারে বেশি দিন টিকে থাকা যাবে না। এছাড়া তৈরি পোশাক শিল্প আমদানিকৃত কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ নির্ভর বলে জাতীয় অর্থনীতিতে এই খাতের মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। তৈরি পোশাক খাত থেকে যে রপ্তানি আয় হয় তার অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ এই শিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানিতে পুনরায় বিদেশে চলে যায়। স্থানীয় কাঁচামাল নির্ভর পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির কোন বিকল্প নেই।