মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সবার জন্য খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা। পৃথিবীতে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদিত হলেও বণ্টন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলতাসহ নানা কারণে চাইলেই সবার জন্য খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা যায় না। এমন অনেক দেশ আছে যেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ না খেয়ে অথবা অর্ধাহারে দিন যাপন করে। আবার অনেক দেশেই খাদ্য অপচয় করা হয়। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি খাদ্য অপচয় করা হয় সৌদি আরবে। দেশটিতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ খাদ্য অপচয় করা হয়। বিশ্বে এখন নিরাপদ খাদ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে যাতে সবাই প্রতিদিন তাদের চাহিদা মতো খাদ্য পেতে পারে। খাদ্য নিরাপত্তা আর নিরাপদ খাদ্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
কোন জনপদের মানুষের জন্য খাদ্য যোগান নিশ্চিত করতে পারাকে খাদ্য নিরাপত্তা বলা যেতে পারে। আর সরবরাহকৃত খাদ্য কোন দেশের জন্য কোন ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি না করলে তাকে নিরাপদ খাদ্য বলা যায়। খাদ্য নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য বিষয় দু’টি পরস্পর নিবিড়ভাবে যুক্ত। বিশ্বে প্রচুর পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হলেও দেশে দেশে অঞ্চলে অঞ্চলে বণ্টন ব্যবস্থার অসমতার কারণে সবার জন্য ন্যায্যতা অনুসারে খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। উপরন্তু প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যের অপচয় হয়। খাদ্যের অপচয় একটি মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য হবার দাবি রাখে। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫৫ বছরে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেড়েছে আড়াই গুণেরও বেশি। আর খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ। খাদ্য উৎপাদন যেভাবে বেড়েছে তাদের বাংলাদেশ খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হবার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এখনো অনেক পরিবার তিন বেলা পেট পুরে খেতে পায় না। একদিকে খাদ্যাভাব অন্যদিকে খাদ্যের অপচয় বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে খাদ্য অপচয় কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তারপরও বিষয়টি ঘটছে এবং দিন দিন বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি রাজধানীতে একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আয়োজিত জাতীয় সম্মেলনে দেশে ক্রমবর্ধমান খাদ্য অপচয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, প্রতি বছর দেশে যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হয় তা খামার থেকে ভোক্তার খাবার টেবিলে পৌঁছানো পর্যন্ত ৩৪ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ অপচয় বা নষ্ট হয়। প্রতি বছর নষ্ট হওয়া খাদ্যের পরিমাণ হচ্ছে ২ কোটি ১০ লাখ টন। বিশ্বব্যাংক ও বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির মূল্যায়ন অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখনো ১ কোটি ৫৫ লাখ থেকে কোটি ৬০ লাখ মানুষ চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এক শ্রেণির মানুষ অতি ভোজন করেন এবং এ অতিভোজনের সময় তারা বিপুল পরিমাণ খাদ্য নষ্ট করে থাকেন। প্রতি বছর বাংলাদেশের আবাদযোগ্য জমির প্রায় ২৭ শতাংশের উৎপাদিত ফসলের সমান খাদ্যপণ্য নষ্ট হচ্ছে। অনেক সময় তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক বা উৎপাদনগণ সঠিক মূল্য না পাবার কারণে নিজেরাই উৎপাদিত পণ্য ধ্বংস করে ফেলেন। প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্য নষ্ট বা অপচয় হচ্ছে তার আর্থিক পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৪ শতাংশের মতো। কৃষিপণ্য উৎপাদনের পর বেশ কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে তা ভোক্তার টেবিলে পৌঁছে। এ সময় বিপুল পরিমাণ পণ্য নষ্ট হয়। উৎপাদন পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই ৮ থেকে ১৫ শতাংশ চাল, ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ সবজি, ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মাছ এবং ১৭ শতাংশ পোল্ট্রি মুরগি নষ্ট হয়।
একটি জরিপ থেকে দেখা গেছে, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের তুলনায় উচ্চ বিত্ত পরিবারে খাদ্য অপচয় বেশি হয়। উচ্চ বিত্ত পরিবারের প্রতি সপ্তাহে ২ কেজি খাবার নষ্ট করে থাকে। ২০২৪ সালের হিসাব মোতাবেক, দেশে একজন ব্যক্তি প্রতি বছর গড়ে ৮২ কেজি খাবার নষ্ট করেন। মাছ আহরণের সময় বিপুল পরিমাণ পোনা মাছ ধ্বংস করা হয়। ফলে মাছের উৎপাদন যেভাবে বৃদ্ধি পাবার কথা ছিল তা হচ্ছে না। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদের জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কোনভাবেই খাদ্যপণ্য যাতে নষ্ট না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ দ্রুত কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জনগণের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হলে প্রতিটি ক্ষেত্রে খাদ্যের উৎপাদন যেমন বাড়াতে হবে তেমনি উৎপাদিত খাদ্য যাতে নষ্ট বা অপচয় না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।