কী বলার ছিল কী বলছি, কী করার ছিল কী করছি? এ প্রশ্ন আজ পুরো সভ্যতার প্রতি। মানুষের মধ্যে আজ কত ভেদ; কত বিভেদ। মানুষ এখন আর মানুষের বন্ধু নয়। এখন আর মৈত্রীর আহ্বান শোনা যায় না। মানুষ তো এখন প্রকৃতিরও বন্ধু নয়। কী অপরাধ করেছে আমাদের এই ধরিত্রী? অথচ মহান প্রভু এ পৃথিবীকে মানব-বান্ধব করে সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু মানুষ এখন ধরিত্রী-বান্ধব নয়। মানুষ মানুষের শত্রু, ধরিত্রীরও বন্ধু নয় মানুষ। তাহলে মানুষ এখন কার বন্ধু? আসলে মানুষ এখন কারো বন্ধু নয়, নিজেরও বন্ধু নয় সে। এমন দুরবস্থায় কী করে পতিত হলো মানুষ? দুরবস্থার ইতিহাস দীর্ঘ। তবে শুরুটা হয়েছে স্রষ্টার প্রতি অকৃতজ্ঞতার পাপ থেকে।

মানুষ এখন মানুষের প্রতি হলাহল ছড়ায়। বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এটাই এখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, এটাই এখন বিশ্বব্যবস্থা, আরো বড় করে বলতে গেলে সভ্যতা। এ সভ্যতার উগ্র উদাহরণ গাজা এবং এখন ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ। ইরানে ইসরাইলি আগ্রাসনের এক সপ্তাহ পার হয়েছে। আগ্রাসনের জবাবে ইরানও পাল্টা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলি ভূখণ্ডে। প্রাণ বাঁচাতে ভূগর্ভস্ত বাঙ্কারে আশ্রয় নিচ্ছে ইসরাইলিরা। আলো ঝলমলে পরিবেশে ভালোই তো ছিল ইসরাইলিরা। আজ কেন এ করুণ পরিণতি? এমন পরিণতির মূলে রয়েছে রাজনীতি, ভূরাজনীতি। এসব দিয়ে এখন মানুষ কী করবে? এমন প্রশ্ন যেমন ইসরাইলের সাধারণ মানুষের, তেমনি ইরানের সাধারণ মানুষেরও। ওরাতো এখন পারমাণবিক বোমার আতঙ্কেও নিদ্রাহীন। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে তো এ বোমার চর্চা হয়েছে। সে ধ্বংসলীলা মানুষ দেখেছে। তার জের এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে জাপান। মাঝে মাঝে মনে হয়, সুস্থ অবস্থায় পরাশক্তি হওয়া যায় না। এ জিনিস হতে হলে বিকৃতি প্রয়োজন, প্রয়োজন হৃদয়বৃত্তির বিনাশ। নাহলে পরাশক্তি পারমাণবিক বোমার নাম কী করে রাখে ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাটম্যান’। কোনো মানুষ কি এমন নিষ্ঠুর রসিকতা করতে পারে? ফলে বলতে হয়, এমন রসিকতা কেবল অমানুষদের ক্ষেত্রেই মানায়।

ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে মানুষ মরছে, বহু যত্নে গড়ে তোলা হাজারো পরিবারের বিনাশ ঘটছে। চারদিকে আহাজারি, হাহাকার আর ধ্বংস। এ পথেই হয়তো সেক্যুলার সভ্যতার স্ফূর্তি। ফলে লক্ষ্য করা গেল, ইরানে ইসরাইলি আগ্রাসনের পর সে অনাচারে যুক্তরাষ্ট্রের সংযুক্তি। ইরানের তিন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে এখন আবার দেশটিতে শুরু হয়েছে প্রথাগত নাটক। ইরানে হামলা প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই মার্কিন কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যদের অনেকেই একে স্বাগত জানিয়েছেন। কেউ কেউ, আবার সমালোচনা করে বলেছেন, ‘এ যুদ্ধ আমাদের নয়’। তবে বেশি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ডেমোক্রেট আইন প্রণেতারা। তারা বলেছেন, ট্রাম্প কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে একক সিদ্ধান্তে যে হামলা করেছেন, তা সংবিধান বিরোধী। এখন প্রশ্ন হলো, ইরানের তিন পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন আগ্রাসী হামলার যে ঘটনা, তা নিয়ে মার্কিন রাজনীতিবিদদের আলোচনায় কি পরিস্থিতির গুণগত কোনো পরিবর্তন হবে? যুক্তরাষ্ট্র আগ্রাসন চালিয়েছে এবং বোমার কাজ বোমা করেছে। এখন ওনারা যা করছেন, সেটা আসলে ওনাদের দলীয় রাজনীতির প্রথাগত চর্চা। ইরানের হামলার আগেও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানরা ছিলেন। তাতে বিশ্বের কী উপকার হয়েছে? তাদের রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্যেই তো গাজা নামক একটি জনপদ ধ্বংস হয়ে গেলো এবং তা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইল তোষণের কারণে। এ নীতিতে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে এক অদ্ভুত ঐক্য। এর মানে হলো, মুসলিম বিরোধী যে বর্ণবাদ তার ব্যাপ্তিতে তাদের ভূরাজনীতি একই রকম।

এবার ইরানে ইসরাইলের হামলা প্রসঙ্গে বারবার উঠে আসছে, ইরানের পারমাণবিক বোমা অর্জনের সক্ষমতা প্রসঙ্গটি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল কোনোভাবেই চাইছে না, ইরান একটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে উঠুক। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, ইসরাইলই যেন মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকে। যাতে তারা সহজেই তাদের সামরিক আধিপত্য বজায় রাখতে পারে। আর এর মাধ্যমে তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলটিকে তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এই চাওয়ায় যুক্ত হয়েছে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ। এমন ভূরাজনীতির কারণে পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার ইসরাইলকে এক রকম অপ্রতিরোধ্য ও জবাবদিহিহীন করে তুলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে তারা তাদের প্রতিবেশীদের ভয় দেখাতে পারে। তারা এমন হুমকিও দেয়, অস্তিত্ব সংকটে পড়লে আমরা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবো। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গেভির এ সপ্তাহে ইরানের উদ্দেশে এমন এক হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে আরও কঠিন দিন আসছে, হিরোশিমা ও নাগাসাকির কথা সব সময় মানে রাখবেন।’

ইরানে ইসরাইলের হামলা নানাভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একজন আসামী। তার বিরুদ্ধে রয়েছে মানবতা বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ। গাজার জনগণকে ক্ষুধার মাধ্যমে হত্যার দায়েও তিনি অভিযুক্ত। অথচ এমন একজন নিকৃষ্ট ব্যক্তিকে বছরের পর বছর ধরে নির্লজ্জভাবে সমর্থন দিয়ে যেতে পাশ্চাত্যের আভিজাত্যে ও বিবেচনাবোধে বাধছে না। এর এক বড় কারণ বর্ণবাদ, আর এক কারণ তেল সম্পদ। পাশ্চাত্য তাদের পথে বাধা হিসেবে বিবেচনা করছে হামাস এবং ইরানকে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরাইল এখন ইরানকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আর এক সংস্করণে পরিণত করতে চাইছে। যেন তারা অনুগত থাকে, যেন হালকা সশস্ত্র শাসনব্যবস্থা ধারণ করে থাকে- যা সম্পূর্ণভাবে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু ইরানের বর্তমান শাসকরা তাদের অবজ্ঞা করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মত আচরণ করছেন। ইসরাইলের হামলার পাল্টা জবাব দিচ্ছেন। ইসরাইল তার আগ্রাসন শুরু করেছিল গাজা ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। এরপর লেবাননের হিজবুল্লাকে টার্গেট করে। সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পতনের পর ইসরাইল সিরিয়ার কিছু অংশ দখলে নিতে সক্ষম হয়। এরপর সামরিক অবকাঠামোর অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করে ইরানে বিমান হামলার পথ প্রশস্ত করে। এগুলো ছিল ইরানে আগ্রাসন চালানোর পথ সুগম করার প্রাথমিক পর্ব।

ইরানকে পরাজিত করতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র নতুন করে আঁকার চেষ্টা করবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল- এমনটাই মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। তারা মনে করেন, ইরানে আগ্রাসন পেণ্টাগণের ‘বিশ্বব্যাপী পূর্ণাঙ্গ আধিপত্য বিস্তার’ পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তারা এমন একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে। গাজা পরিস্থিতি এবং ইরানে আগ্রাসনের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। পরিস্থিতি যদি এদিকেই অগ্রসর হয়, তাহলে কি মানবজাতির জন্য অপেক্ষা করছে এক ভীতিপ্রদ বিশ্বব্যবস্থা? আমরা তো এতক্ষণ এক পরাশক্তির পরিকল্পনা ও বিশ্লেষকদের ধারণা নিয়ে কথা বলছিলাম।

তবে বিশ্বে আরো পরাশক্তি আছে। আছে ছোট ছোট বহু রাষ্ট্র। ছোটরা এক হয়ে গেলে কিন্তু অনেক বড় হয়ে যায়। আর দেশে দেশে কোটি কোটি জনতা আছেন, তাদের ইচ্ছা ও শক্তির বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তারাই তো সরকার গড়েন এবং ভাঙেন। অতএব আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয়ও আছে। বর্তমান সেক্যুলার সভ্যতায় আমরা বড় একটি বিষয় ভুলে বসে আছি। আর সেটি হলো মহান স্রষ্টার অনুমোদন। মানুষের হাতেই যদি সবকিছু থাকতো, তাহলে তো রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন হতো না। আমরা জানি ‘বাড়াবাড়ি’ বিষয়টি স্বাভাবিক নয় এবং টিকে থাকার মতোও নয়। বাড়াবাড়ির পরিণতি পতন। পরাশক্তিবর্গ ইতিহাসের এ শিক্ষা উপলব্ধি করলে মঙ্গল। লেখাটি শেষ করার পর জানতে পারলাম যুদ্ধবিরতিতে গেছে ইরান-ইসরাইল। আর যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। তবে ট্রাম্পে আস্থা রাখা কঠিন, সেকুল্যার দর্শনেই সে বীজ নিহিত।