নববর্ষ একান্তই আমাদের নিজস্ব একটি উৎসব। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এবং বিশ্বের নানাস্থানে থাকা বাংলা ভাষাভাষীরা নতুন বাংলা বছরকে বরণ করে নেয়। পৃথিবীর সব দেশ ও সব জাতির মানুষের কাছেই নববর্ষ আনন্দেরই দিন। চীনারা নতুন বছর উপলক্ষে একটানা কয়েকদিন উৎসব করে। পারস্য জাতিগোষ্ঠীও তাদের নওরোজকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। তবে বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ততটা প্রাণ খুলে নববর্ষ উদযাপন করতে পারেনি রাজনৈতিক অচলায়তন ও অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের কারণে।
বিশেষ করে বিগত ১৫ বছর পতিত ফ্যাসিবাদী সরকার নববর্ষ উৎসবকেও দলীয়করণ করেছিল। নববর্ষ এমন এক ধরনের রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল যার মাধ্যমে নিজেদের আদর্শিক এজেন্ডা প্রতিষ্ঠা করা হতো আর বিরোধীদের হেয়প্রতিপন্ন করা হতো। সে অপশাসনের পতনের পর এবারই প্রথম নববর্ষ উৎসব আয়োজনের সুযোগ পেল দেশবাসী। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো ধরনের ভয় ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই রাজপথে নেমে এসে এবার আনন্দে মেতে উঠেছিল। কারো মধ্যে জড়তা ছিল না। অস্বস্তি ছিল না। সকল দল, মত ও চিন্তাধারার মানুষ এক হয়ে আনন্দ করেছে, উৎসবকে উপভোগ করেছে।
বরাবরের মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে একটি শোভাযাত্রা বের করা হয়। এ শোভাযাত্রা এবার তার প্রতিষ্ঠাকালীন নামে ফিরে গেছে। প্রথম যখন এ শোভাযাত্রা করার প্রচলন শুরু হয় তখন এর নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। পরবর্তীতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আর বিজাতীয় আগ্রাসনের প্রভাবে একে বানিয়ে দেয়া হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ পরিবর্তন নিয়ে জনমনে চাপা ক্ষোভ ছিল। ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ামাত্রই তাই চারুকলার সাবেক ছাত্রছাত্রীরা সক্রিয় হয় এবং তারা তাদের হারানো নাম ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। অন্যবারের তুলনায় এবারের আয়োজনে ভিন্নতা দেখা গেছে। শোভাযাত্রায় স্থান পেয়েছে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’। এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্যে তথা ‘বাংলা নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ শ্লোগানেও অপশক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট হয়।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, এবারের শোভাযাত্রায় তার প্রতিফলন ঘটানোর একটি প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। এবারের উৎসবের প্রতিপাদ্যে দু’টি বিষয় ছিল। প্রথমত-নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবসানে জাতির উল্লাস এবং আনন্দ; আরেকটি ছিল ঐক্য এবং সম্প্রীতির ডাক। এটি কেবল বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বের নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতা ও সমর্থন প্রকাশ করে। এটি আরো স্পষ্ট হয়ে গেছে এ কারণে যে, নববর্ষ উদযাপনে এবারের বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন অংশগ্রহণকারীরা। শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া অনেকের হাতে দেখা গেছে ফিলিস্তিনের পতাকা, কেউবা ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ লেখা পোস্টার ও ব্যানার বহন করেছেন।
অন্যদিকে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন ও বর্ষবরণ শোভাযাত্রার মূল আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোভাযাত্রার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছে। ২০১৬ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশের বর্ষবরণ শোভাযাত্রাকে বিশ্বের অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যে উদ্দেশ্য নিয়ে জাতিসংঘ এ স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেখানে তিনটি বিষয় উল্লেখ ছিল। প্রথমত, যতবেশি সংখ্যক সাংস্কৃতিক এবং নৃতাত্তিক বৈচিত্র্য তুলে ধরা যায়। এবছর সর্বোচ্চ সংখ্যক নৃগোষ্ঠী, সমতল, পাহাড়ি এবং বাঙালি জাতিসত্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিষয় ছিল আলাপ-আলোচনা করা। এবার আয়োজন করতে গিয়ে দেশব্যাপী বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয়ত, দৃষ্টিনন্দন করার কথা বলা হয়েছে। এবার বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজন করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান আমাদের সামনে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে। আমাদের এসব ঐতিহ্য শুধু যেন নিজেদের মধ্যেই না থাকে, আমাদের সংস্কৃতি যেন আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি বিশ্ব দরবারে। বছরের এই দিনটিতে আমরা আমাদের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে উৎসবমুখর পরিবেশে তুলে ধরার এবং সার্বিকভাবে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার সুযোগ পাই। সে ধারা যেন অব্যাহত থাকে, নতুন বছরে বাংলাদেশ যেন ভালো থাকে, আর কোনো অশুভ শক্তি যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ না পায়-এই আমাদের কামনা।