বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এক ঐতিহাসিক অধ্যায় যুক্ত হলো ১৮ নভেম্বর। বিশ্বের ১৪৩টি দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে নির্বাচন কমিশন যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা শুধু একটি প্রশাসনিক উদ্যোগ নয়-এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করার এক স্মরণীয় পদক্ষেপ। বহুদিন ধরে প্রবাসীরা যে অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন, অবশেষে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সে অপেক্ষার অবসান ঘটলো।

প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ জাতীয় আয়ের অন্যতম স্তম্ভ, যা বিপুল সংখ্যক পরিবারকে স্থিতিশীলতা দিয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করেছে। দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গেও তাদের আত্মিক ও মানসিক সম্পর্ক গভীর। অথচ তাদের ভোটাধিকার দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবে প্রয়োগের সুযোগ পায়নি। এমন একটি জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার অবশেষে স্বীকৃতি পেলÑএ অর্জন নিঃসন্দেহে জাতীয় রাজনৈতিক উন্নতির একটি বড় অগ্রগতি।

এমন একটি জটিল ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া মাত্র তিন মাসে সম্পন্ন করার যে দুঃসাহসিক উদ্যোগ নির্বাচন কমিশন দেখিয়েছে, তা প্রশংসার দাবিদার। ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপ মূলত একটি আইটি-সাপোর্টেড ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে প্রবাসীরা অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারবেন এবং পরে ডাকযোগে ব্যালটে ভোট প্রদান করবেন। ফলে ডিজিটাল ব্যবস্থার সুবিধা ও প্রচলিত ডাকব্যবস্থার নিরাপত্তা-দু’পদ্ধতির সংমিশ্রণে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, এ উদ্যোগ কেবল একটি অ্যাপ তৈরির বিষয় নয়; এটি পুরো প্রক্রিয়ার সমন্বয়, নিরাপত্তা, যাচাইবাছাই ও ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি বড় কর্মযজ্ঞ। অঞ্চলভিত্তিক সময়সূচি ধার্য করে প্রবাসীদের ২৩ নভেম্বর থেকে ধাপে ধাপে নিবন্ধন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত সব অঞ্চলের জন্য পৃথক নিবন্ধনের সময় নির্ধারণ প্রশাসনিক পরিকল্পনার সুস্পষ্ট পরিচয় বহন করে।

যদিও এ উদ্যোগে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, তবুও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জও আমলে নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, ডাকব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতার কারণে ব্যালট ফেরত পাঠাতে সময় লাগতে পারে, যা ভোট গণনার আগে প্রশাসনিকভাবে জটিলতা তৈরি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, অ্যাপ ব্যবহার করতে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রয়োজন হবে, যা সব প্রবাসীর জন্য সমানভাবে সহজ নাও হতে পারে। তৃতীয়ত, নিবন্ধন যাচাই, সঠিক ঠিকানায় ব্যালট পাঠানো এবং রিটার্নিং অফিসারদের দ্বারা পৃথক ভোটার তালিকা তৈরিÑএসব ক্ষেত্রেই প্রয়োজন অতিরিক্ত সতর্কতা ও জনবল।

ইসির তথ্যানুযায়ী প্রাথমিকভাবে ২০ লাখ ব্যালট পেপার ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা প্রবাসীদের বিশাল ভোটার পরিসরের প্রেক্ষাপটে একটি বাস্তবসম্মত সূচনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ব্যালটে কেবল প্রার্থীর প্রতীক থাকবে-এ সিদ্ধান্ত কার্যক্রমকে সহজ করেছে, যদিও এর নেতিবাচক দিকও আছে। প্রার্থীর নাম বা ছবি না থাকায় কিছু ভোটারের জন্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই অ্যাপের প্রার্থী তালিকা নিয়মিত হালনাগাদ ও সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি।

সবচেয়ে বড় সত্য হলো-এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। প্রবাসীরা এতদিন ভোটাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় নির্বাচন ফলের ওপর তাদের মতামতের প্রতিফলন আসেনি। এবার তাদের ভোট দেশের নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখবে, সংসদে জনগণের বহুমাত্রিক প্রতিনিধিত্ব আরও জোরদার হবে। নির্বাচন কমিশনের এ উদ্যোগকে সফল করতে হলে এখন প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বয়। বিদেশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস, ডাক বিভাগ, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং প্রবাসীদের নিজস্ব সংগঠনÑসবাইকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। প্রবাসীদের প্রযুক্তিগত সহায়তা, সচেতনতা বৃদ্ধি, নিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্য প্রচারÑএসব ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।

সর্বোপরি, এ উদ্যোগ প্রবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা ও সম্মানের প্রতীক। যারা দেশের বাইরে থেকেও দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়, তাদের নাগরিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া একটি সভ্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ ব্যবস্থা সেই দায়িত্ব পালনের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।