৩০ আগস্ট বিবিসি সূত্রে একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে গণমাধ্যমে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে অবস্থানরত বহু রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থার তরফ থেকে শুক্রবার প্রকাশিত বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ভারতে থাকা শতাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও নির্বিচার আটকের তথ্য পেয়েছেন তারা। এইচআরডব্লিউ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাড়িয়ে দিয়ে মানুষের জীবন ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি চরম অবহেলার পরিচয় দিয়েছে ভারত সরকার। মে মাসে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি অবৈধ অভিবাসীদের উৎখাত অভিযান শুরু করে, যার শিকার হয় অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাভাষী মুসলিম। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থায় (ইউএনএইচসিআর) নিবন্ধিত থাকার পরও অন্তত ১৯২ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। কর্তৃপক্ষ আরও ৪০ জনকে মিয়ানমারের উপকূলের কাছাকাছি নিয়ে সাঁতার কেটে তীরে যেতে বাধ্য করে বলে অভিযোগ রয়েছে। দমন নীতির ভয়ে অনেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশের কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরে সম্প্রতি ভারত থেকে আসা নয়জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। মে মাসে বিতাড়িত ছয়জন অভিযোগ করেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের অর্থ, মুঠোফোন এবং ইউএনএইচসিআর নিবন্ধন কার্ড কেড়ে নিয়েছেন। আনুমানিক ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ভারতে বাস করেন। যাদের অন্তত ২০ হাজার ইউএনএইচসিআর-এ নিবন্ধিত।

ভারত ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশন বা এর ১৯৬৭ সালের প্রোটোকলে স্বাক্ষরকারী না হলেও, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ‘নন রিফাউলমেন্ট’ নীতির অধীন। যে নীতি অনুযায়ী কাউকে এমন দেশে ফেরত পাঠানো নিষেধ, যেখানে তার জীবন বা স্বাধীনতার হুমকি রয়েছে। ভারতের আসাম রাজ্যের গোলপাড়া জেলায় আটক ৩৭ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা ৬ মে রাতে বন্দুকের মুখে স্বামী ও তিন সন্তানসহ তাদের বাংলাদেশে ঢুকতে বাধ্য করে। পরিবারটি ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর জাতিগত নিধন অভিযান থেকে বাঁচতে পালিয়ে মিয়ানমার ছেড়েছিল। ভারতের আসামে এক দশকেরও বেশি সময় তারা জেলে কাটিয়েছে। ৬ মে দিল্লিতে ১৩ জন নারীসহ ৪০ জন মুসলিম ও খৃস্টান রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। এরপর তাদের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজে উঠতে বাধ্য করা হয়। শরণার্থীদের অভিযোগ জাহাজের কর্মীরা তাদের মারধর করেছে। এক খৃস্টান রোহিঙ্গা বলেন, মিয়ানমান উপকূলের কাছে পৌঁছলে শরণার্থীদের লাইফ জ্যাকেট দিয়ে সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক টম অ্যান্ড্রুজ বলেন, যাদের জীবন এবং নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক সুরক্ষা প্রয়োজন, তাদের প্রতি এই ঘটনায় প্রকাশ্যে অবহেলা দেখানো হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, এসব ঘটনায় ভারতে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। এদিকে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ঘোষণা করেছে, দেশটিতে থাকা রোহিঙ্গারা ‘শরণাথী’ নাকি ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে অধিকার ও সুরক্ষা পাবে, সেটা তারা নির্ধারণ করবেন। এ সংক্রান্ত পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ সেপ্টেম্বর। এর আগে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে বিতারণ বন্ধে আদেশ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন আদালত এবং রোহিঙ্গাদের সাগরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগকে বানানো গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এদিকে মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন, ভারত সরকারকে অবিলম্বে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভয় দেখানো, নির্বিচারে আটক ও অবৈধ বহিষ্কার বন্ধ করতে হবে এবং নিরপেক্ষভাবে তাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে হবে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রাণ বাঁচাতে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। কিন্তু এখন শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পাওয়াটাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। ভারত তো তাদের সাগরে ফেলে দিচ্ছে। আর আদালত বলছে, রোহিঙ্গারা ‘শরণার্থী’ নাকি ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’, সেটা নির্ধারণ করতে হবে। রোহিঙ্গারা এখন এক যাযাবর জাতিতে পরিণত হয়েছে। কোথাও তাদের ঠাঁই নেই। স্বদেশের শাসকরা জালেম হলে মজলুম নাগরিকদের অবস্থা কতটা করুণ হতে পারে, রোহিঙ্গারা তার বড় প্রমাণ।