কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত জরুরি আরব-ইসলামিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে ইসরাইলের আগ্রাসী হামলা শুধু কাতারের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত নয়, বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মর্যাদার অপমান। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের বক্তব্যে উঠে এসেছে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানÑইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ এবং মানবাধিকারের প্রতি ধারাবাহিক অবজ্ঞা প্রদর্শন করছে এবং এটি আর নীরবে সহ্য করা যাবে না।

দোহায় অনুষ্ঠিত এ সম্মেলন ছিল সময়োপযোগী ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সভাপতিত্বে ২৪টি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। বাকি দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। সম্মেলনে ওআইসি ও আরব লীগের মহাসচিবগণ একসুরে মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত শান্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

কাতারে ইসরাইলের হামলা নিঃসন্দেহে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এতদিন ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ ইসরাইলি দখলদারিত্ব এবার আরব বিশ্বের অন্য সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপরও বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। এটি কেবল একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ফলে বাংলাদেশ যে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সমন্বিত কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেÑতা অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী।

সম্মেলনের যৌথ আহ্বান ছিল স্পষ্ট। গাজায় দখলদারিত্ব অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে; পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ফিলিস্তিনের নারী-পুরুষ যখন অনাহারে মৃত্যুবরণ করছে, তখন গাজায় খাদ্য ও আন্তর্জাতিক সাহায্যের নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করাও জরুরি। সম্মেলনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে-যাতে ইসরাইলি নেতাদের যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের দায়ে জবাবদিহি করতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো-এসব আহ্বান কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বাস্তবে কার্যকর হবে? অতীতে বহুবার ওআইসি এবং আরব লীগ ইসরাইলবিরোধী বিবৃতি দিলেও কার্যকর পদক্ষেপে ঘাটতি থেকে গেছে। এবারও যদি ঐক্যবদ্ধ অর্থনৈতিক চাপ, বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা বা কূটনৈতিক অবরোধ আরোপ করা না যায়, তবে ইসরাইল তার আগ্রাসী নীতি থেকে বিরত হবে না। মুসলিম বিশ্বের কাছে এটি আবারও ব্যর্থতার প্রমাণ হবে।

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিন প্রশ্নে নীতিগত অবস্থান বজায় রেখেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি সরকার ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছে। এ ঐতিহাসিক অবস্থান ধরে রেখেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে নির্ভীক কণ্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষত, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এমন একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যার অবস্থান অনেকাংশে নিরপেক্ষ ও মানবিকÑÑ তাই বাংলাদেশের বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব বহন করে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, ইসরাইলের দখলদার নীতি কেবল একটি আঞ্চলিক সংকট নয়; এটি বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠ যদি বাস্তব পদক্ষেপে রূপ নেয়। তবে ইসরাইলকে জবাবদিহির মুখে পড়তেই হবে। অন্যথায়, সম্মেলন শুধু আরেকটি আনুষ্ঠানিক সভায় সীমাবদ্ধ থাকবে, আর মুসলিম উম্মাহর মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হবে আরও বেশি। এখন সময় এসেছে কথার বাইরে গিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক আইনি লড়াই-সবকিছু সমন্বিতভাবে প্রয়োগ না করলে মুসলিম বিশ্বের এই আহ্বানও ব্যর্থ হয়ে যাবে। বিশ্ব মুসলিম জনতার প্রত্যাশা-এইবার ওআইসি ও আরব লীগ শুধু বিবৃতি দিয়ে থেমে থাকবে না, বরং বাস্তবে ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রদর্শন ঘটাবে।