আগস্ট বিপ্লবের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে যতটা উচ্চাশা পোষণ করা হয়েছিলো, বাস্তবে তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়নি বরং দেশের অপরাধ প্রবণতা খানিকটা পুরনো বৃত্তেই রয়ে গেছে। দেশে প্রতিনিয়তই ঘটছে নানাবিধ অপরাধমূলক ঘটনা। একই সাথে বেড়েছে হত্যাকাণ্ডও। প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে গত মার্চ মাসে ৩১৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। প্রতিটি খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জ্ঞাত হওয়া গেছে। সে অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন ১০টির বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। চলতি মাসেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।

গত ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানায় শতাধিক খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে। সর্বশেষ আলোচিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে রাজধানীর বনানীতে তুচ্ছ ঘটনায় বেসরকারি প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যাকাণ্ড। সম্প্রতি এ ধরনের তুচ্ছ কারণে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যা রীতিমত উদ্বেগের। এসব হত্যাকাণ্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে বেশ কয়েকটি কারণ পাওয়া গেছে। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয়ে সামাজিক সহিংসতা চরম আকার ধারণ করায় এসব হত্যার ঘটনা এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এতে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল নিজের ঘরও সময়ে সময়ে অনিরাপদ হয়ে উঠছে। কিছু ক্ষেত্রে সহিংসতার বলি হচ্ছে শিশু। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে গত মার্চ মাসে ৩১৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। যা দেশের শান্তিপ্রিয় মানুুষকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।

এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনায় মামলা হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে। এর মধ্যে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জে, ৬৬ জন খুন হয়েছে। চট্টগ্রাম রেঞ্জে ৬৫ জন, খুলনা রেঞ্জে ৩৫ জন ও মহানগরের মধ্যে ঢাকায় ৩৩ জনকে হত্যা কারা হয়। এর আগের দু’মাস ফেব্রুয়ারিতে ২৯৪টি ও জানুয়ারিতে ৩০০টি হত্যা মামলা হয়। এসব হত্যাকাণ্ড বিশ্লেষণ ও পুলিশের তদন্ত অনুযায়ী বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের পেছনে যেসব কারণ পাওয়া গেছে, এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক বিরোধ, স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্ব, মাদকদ্রব্য বেচাকেনা, আধিপত্য বিস্তারের জেরে দখল, পারিবারিক বিরোধ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সহিংস আচরণ, সম্পত্তির লোভ, পারিবারিক বিরোধ ও ছিনতাইয়ে বাধা দেয়া। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক, পারিবারিকসহ সব ধরনের অপরাধ বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ মানুষের নৈতিক অধঃপতন ও লোভ। পাশাপাশি অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। একই সঙ্গে অন্যান্য আর্থ-সামাজিক ও মনোগত বিষয়ের পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহারও দায়ী। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবও রয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য অভিযোগ ও অপরাধের ঘটনায় পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। এদিকে তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক পুলিশ বলছে, দেশে প্রায় প্রতিদিন একাধিক হত্যার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা বাড়ছে। তবে সব অপরাধীকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এ মুহূর্তে আইন প্রয়োগের জায়গাটি দুর্বল। তাই আদর্শ ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে আইন প্রয়োগে আরো কঠোর হতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক অন্য ব্যবস্থাগুলোকে ঢেলে সাজানোর আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।

সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে, সম্প্রতি বনানীতে দু’ তরুণীর কথা-কাটাকাটির জেরে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত সোমবার ফেনীর সোনাগাজীতে বিএনপির এক কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঢাকার মগবাজার এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপে আধিপত্য বিস্তারে এক বিএনপি নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই দিন কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলায় হাওরে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে ছুরি মেরে মোকারম মিয়া নামে একজনকে হত্যা করা হয়।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের রাউজানে নিজ বাসায় ভাত খাওয়ার সময় মানিক আব্দুল্লাহকে গুলী করে হত্যা করা হয়। গত ২০ এপ্রিল গাজীপুরের টঙ্গীতে দু’ শিশুসন্তান মালিহা আক্তার ও মো. আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় মা আলেয়া বেগমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই দিন টেকনাফে গণপিটুনি ও ছুরি মেরে নজিবুল্লাহ নামের এক যুবককে হত্যা করা হয়। ১৮ এপ্রিল রাজশাহীতে মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদে তার বাবা নান্টু মিয়াকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একই দিন জায়গাজমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে আবুল কাশেম নামের এক বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। যা আমাদের জাতীয় জীবনে মূল্যবোধের সঙ্কট, অতিমাত্রায় অবক্ষয় ও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতর অবনতির কথায় স্মরণ করে দেয়।

মূলত, সুশাসনের অভাব, আইনের শাসনের বিচ্যুতি, আইনের ভঙ্গুর প্রয়োগ; ক্ষেত্র বিশেষে অপপ্রয়োগ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দেশে অপরাধ প্রবণতা অশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। আসলে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই দেশের অপরাধ প্রবণতা এখন রীতিমত ক্রমবর্ধমান। একই সাথে দেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে প্রতিনিয়ত। তাই দেশে হত্যাকাণ্ড সহ সকল ধরনের অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেশে আইন ও সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠা, সকল ক্ষেত্রে জবাবদিহীতা নিশ্চিতকরণ এবং শাসনকাজে জনগণের অংশ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত করা না গেলে আমাদের কোন অর্জনই ফলপ্রসূ হবে না। এমতাবস্থায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে কোন প্রকার উদাসীনতা কাম্য নয়। অপরাধ হত্যাকাণ্ড সহ সকল প্রকার অপরাধ প্রবণতার লাগাম টেনে ধরা সময়ে সবচেয়ে বড় দাবি।