রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে রাসায়নিক গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু গোটা জাতিকে আবারও নাড়িয়ে দিয়েছে। আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হয়েছে মানুষের পরিশ্রম, ঘাম ও জীবন। নিখোঁজদের খোঁজে স্বজনদের আহাজারি, হাসপাতাল ও ঘটনাস্থলে কান্নার দৃশ্য যেন বারবার আমাদের জাতিগত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি হয়ে ফিরে আসছে। প্রতি বছরই কোথাও না কোথাও আগুনে প্রাণহানি ঘটে, আমরা শোকাহত হই, তদন্তের নির্দেশ আসে, ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেওয়া হয়, কিন্তু কিছুদিন পরই বিষয়টি হারিয়ে যায় জনস্মৃতি থেকেÑ যেন কিছুই ঘটেনি।
এ ভয়াবহ দুর্ঘটনার প্রাথমিক তথ্য বলছে, একটি কেমিকেল গোডাউন এবং পোশাক কারখানা পাশাপাশি থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমাদের রাজধানী এবং দেশের অন্যান্য শহরগুলোতে বছরের পর বছর ধরে এমন অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা গড়ে উঠেছে-আবাসিক ভবনের ভেতরে বা নিচতলায় কেমিকেল, রঙ, প্লাস্টিক বা গ্যাস সিলিন্ডারের গুদাম; ফায়ার সেফটির কোনো ব্যবস্থা নেই; নির্গমন পথ বন্ধ; অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র হয় অচল, নয়তো অনুপস্থিত। অথচ এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। ফায়ার সার্ভিসের বারবার সতর্কতা সত্ত্বেও কার্যকর তদারকি বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
অগ্নিকাণ্ডের পর দেখা যায়-ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রচণ্ড ধোঁয়া, তাপ ও রাসায়নিক গ্যাসের কারণে দীর্ঘসময় ঘটনাস্থলে প্রবেশ করতে পারেন না। এতে উদ্ধার তৎপরতা বিলম্বিত হয় এবং প্রাণহানি বেড়ে যায়। এ ধরনের দুর্ঘটনা যে শুধু দুর্ভাগ্যের ফল নয়, বরং এটি আমাদের প্রশাসনিক উদাসীনতা, শহর পরিকল্পনার বিশৃঙ্খলা ও আইনি প্রয়োগের দুর্বলতার ফল-তা এখন স্পষ্ট।
শুধু মিরপুর নয়, নারায়ণগঞ্জ, চকবাজার, আরমানিটোলা, সীতাকুণ্ডÑপ্রতিটি দুর্ঘটনাই এক একটি ভয়াবহ শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি সে শিক্ষা গ্রহণ করেছি? তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কিন্তু অধিকাংশ রিপোর্ট ধুলো জমে পড়ে থাকে। দোষীদের বিরুদ্ধে বিচার বা দৃশ্যমান শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। ফলে মালিকদের মধ্যে ভয়-সংযমের কোনো বোধ গড়ে ওঠে না। এখন সময় এসেছে কঠোর বাস্তবতা মেনে নেওয়ার-এ অগ্নিকাণ্ডগুলো কেবল ‘দুর্ঘটনা’ নয়, বরং প্রতিরোধযোগ্য বিপর্যয়। এগুলো আমাদের আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতার ফল।
এ অবস্থার পরিবর্তনে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠান, গুদাম, কারখানা ও বাণিজ্যিক স্থাপনাকে বাধ্যতামূলকভাবে অগ্নি নিরাপত্তা মানদণ্ডের আওতায় আনতে হবে। ফায়ার সেফটি লাইসেন্স, জরুরি নির্গমন পথ, অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী-সবকিছু নিশ্চিত না হলে কোনো স্থাপনা চালুর অনুমতি দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে নগর পরিকল্পনা ও বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আবাসিক এলাকার মধ্যে বিপজ্জনক শিল্প বা কেমিকেল গোডাউন পরিচালনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। এসব স্থাপনার অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন ও স্থানান্তর জরুরি।
শুধু সরকারি তৎপরতা নয়, নাগরিক সচেতনতা গড়েও এ বিপর্যয় রোধ সম্ভব। ভবন মালিক ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে যে, অগ্নি নিরাপত্তায় বিনিয়োগ কোনো বাড়তি খরচ নয়-এটি মানবজীবন রক্ষার দায়বদ্ধতা। শ্রমিকদের নিয়মিত অগ্নি প্রতিরোধ প্রশিক্ষণ দিতে হবে, উদ্ধার মহড়া আয়োজন করতে হবে, আর স্থানীয় জনগণকেও সতর্ক ভূমিকা রাখতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের পর নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো, ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা বা তদন্তের নির্দেশ দেওয়া মানবিক উদ্যোগ হলেও-তা যথেষ্ট নয়। রাজধানীসহ সারাদেশে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করছে-আমরা এখনও সেই ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি। অতএব, এখনই সময়- ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারিÑসব পর্যায়ে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার। শোক নয়, প্রতিরোধ চাই। আর এ প্রতিরোধ গড়তে হবে সম্মিলিতভাবে-জীবন বাঁচানোর দায়বদ্ধতা থেকে, মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে।