মাগুরার আছিয়া নামের শিশুটির ওপর যেভাবে ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে তা আমাদের বিবেককে কাঁপিয়ে দিয়েছে। আমরা শিক্ষিত, উন্নত ও সমৃদ্ধ হওয়ার পরও নৈতিকভাবে আমরা যে ক্রমাগত অধ:পতনের দিকে যাচ্ছি সে বাস্তবতা ক্রমশই যেন স্পষ্ট হচ্ছে। শিশুদের ওপর সহিংসতা ও যৌন নিপীড়নের ওপর সাম্প্রতিক সময়ে আন্দোলন হচ্ছে। নানা রকমের আইন ও বিধান জারির প্রস্তাবনাও এসেছে। সেগুলো সবই জরুরি। কিন্তু তারপরও প্রকৃত বাস্তবতা হলো, পরিবারের শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে পরিবারকেই বিশেষ করে সন্তানদের বাবা-মা ও অভিভাবকদেরই নিতে হবে।

আমাদের সন্তানেরা বিশেষ করে তারা যদি নাবালক বা নাবালিকা হয়, তাহলে তারা বাইরে যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণই অভিভাবকদের চোখে চোখে রাখা উচিত। সন্তানদের সময় দেওয়া প্রতিটি বাবা-মায়ের জন্য জরুরি। বিশেষ করে চারপাশে নিজেদের সবকিছুর মান যেভাবে ক্রমান্বয়ে নীচের দিকে নামছে, সেখানে সন্তানদের বিষয়ে আরো অনেক বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। যে পরিবারে বাবা-মা দুজনেই কর্মব্যস্ত থাকেন বা ঘরের বাইরে থাকেন- সেখানে বাচ্চারা নেশা, পর্নগ্রাফি কিংবা না বলা আরো অনেক ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। অভিভাবকেরা সময় দিলেই সন্তানেরা সবাই উত্তম হয়ে যাবে তেমনটাও হয়তো নিশ্চিত করে বলা যাবে না; তথাপি অভিভাবকদের দিক থেকে সন্তান প্রতিপালনের সর্বোচ্চ চেষ্টাই থাকা উচিত।

পাশাপাশি, সন্তানদের সুরক্ষার জন্য তাদের আশপাশে কারা যাচ্ছে বা আসছে, সেদিকেও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশি বা বাড়িতে আসা অন্য যে কারো ব্যাপারেই নজর রাখা দরকার। কারো ওপর অন্ধ বিশ্বাস বা অন্ধভাবে সুধারণা রাখার সুযোগ ক্রমাগতভাবে কমে আসছে। কারণ কে কোন দৃষ্টিতে আপনার আমার সন্তানকে দেখে, কিংবা কার মনে কী চলছে-তা আমরা জানি না। তাই ঢালাওভাবে সবার ওপর ভরসাও রাখা যাবে না। আবার অনেক সময় এমনও হয়, আমাদের সন্তানেরা হয়তো পরিচিত কারো ব্যাপারে, কারো অঙ্গভঙ্গির ব্যাপারে আমাদের কাছে নালিশ করে কিংবা তাদের আপত্তির কথা জানায়। অথচ আমরা তাতে পাত্তা দেই না। আমাদের সন্তানদের আপত্তি বা অভিযোগের চেয়ে আমরা পরিচিতজনকে বেশি বিশ্বাস করি। কিংবা পরিচিতজনদের সাথে সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি নিয়েই বেশি তৎপর হই। অথচ একটি সময়ে গিয়ে প্রমাণিত হয় যে, সন্তানদের আপত্তি বা অভিযোগ আসলে যথার্থ ছিল।

এ কথা এখন অনেকেই জানেন যে, শিশুরা তাদের জীবনে প্রথম নিগৃহীত হয় তাদেরই পরিবারে অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা পরিচিত কোনো স্থানে। তাই এসকল জায়গায় শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিতে অভিভাবক এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্তাব্যক্তিদের সর্বোচ্চ পরিমাণ সচেতন ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর নির্দেশনাগুলো সর্বাবস্থায় প্রণিধানযোগ্য। ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, আজ থেকে ১৪শ বছর আগে যখন সমাজে এত ধরনের অপরাধ ছিল না, পর্নগ্রাফির সয়লাব ছিল না, তখনই রাসূল (সা.) শিশুদের নিরাপত্তায় বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়ে গেছেন যেগুলো আজকের সময়ের বাস্তবতার নিরিখেও খুবই প্রয়োগযোগ্য।

হযরত আমর ইবনু শুআইব (রহ.) থেকে পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও তার দাদার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হলে তাদেরকে নামাজের জন্য নির্দেশ দাও। যখন তাদের বয়স দশ বছর হয়ে যাবে তখন নামাজ আদায় না করলে তাদেরকে শাসন করবে। তাদের ঘুমের বিছানা আলাদা করে দিবে। (সুনানে আবু দাউদ ৪৯৫, মুসনাদে আহমাদ ৬৬৮৯, সুনানে দারা কুতনি ৮৮৮)

আত্মীয় স্বজন বা পরিচিত কেউ কিংবা লজিং শিক্ষক- এদের কারো সাথে যদি সন্তানকে এক ঘরে রাখতে হয় তাহলেও সর্বোচ্চ সতর্কতা বিধান করা জরুরি। একই কাঁথার নীচে নিকটাত্মীয়দের সাথেও সন্তানকে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে সন্তানদের প্রতি বাড়তি স্নেহ, কিংবা পরিচিতজনের ওপর অন্ধবিশ্বাস যেন প্রতিবন্ধকতা হয়ে না দাঁড়ায়। সন্তানদের জন্য বিশেষ করে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য আরো নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আছে। আছিয়ার ওপর ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের সবাইকে সচেতন করুক, দায়িত্ববান করুক।