জাফর আহমাদ

“আল্লাহ একটি উপমা পেশ করেছেন একজন ক্রীতদাসের- সে কতিপয় রূঢ় চরিত্র প্রভুর মালিকানাভুক্ত, যারা সবাই তাকে নিজের দিকে টানে এবং আরেক ব্যক্তি যে পুরোপুরি একই প্রভুর ক্রীতদাস। এদের দু’জনের অবস্থা কি সমান হতে পারে? সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞতায় ডুবে আছে।” (সুরা যুমার : ২৯)

এ উপমাতে আল্লাহ তা’আলা শিরক ও তাওহীদের পার্থক্য এবং মানবজীবনের ওপর এ দু’টির প্রভাব এমন পরিস্কারভাবে বর্ণনা করেছেন যে, এতো বড় বিষয়কে এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত কথায় এবং এতটা কার্যকর পন্থায় বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। একথা সবাই স্বীকার করবে , যে ব্যক্তি অনেক মালিক বা মনিবের অধীন এবং তারা প্রত্যেকেই তাকে নিজের দিকে টানে। তারা এমন বদমেজাজী যে, প্রত্যেকে তার সেবা গ্রহণ করতে চায় কিন্তু অন্য মালিকের নির্দেশ পালনের সুযোগ তাকে দেয় না, তাছাড়া তাদের পরস্পর বিরোধী নির্দেশ শুনতে গিয়ে যার নির্দেশই সে পালন করতে অপারগ হয় সে তাকে শুধু ধমক ও বকাঝকা দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, বরং শাস্তি দিতেও বদ্ধপরিকর হয়। প্রত্যেকে তাদের গায়ের জোর খাটিয়ে তাকে টানা হেচড়া করতে থাকে, ব্যাচারা মাঝে পড়ে জীবন অনিবার্যরূপেই অত্যন্ত সংকীর্ণতার মধ্যে নিপতিত হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি একই মনিবের চাকর সে ব্যক্তি অতীব আরাম ও শান্তিতে জীবন যাপন করে। তাকে অন্য কারো খেদমত এবং সন্তোষ বিধান করতে হয় না। এটা এমন সহজ সরল কথা যা বুঝার জন্য বড় বেশী চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন হয় না। এ উপমা পেশ করার পর কারো জন্য এ কথা বুঝাও কঠিন নয় যে, এক আল্লাহর দাসত্বে মানুষের জন্য যে শান্তি ও নিরাপত্তা আছে বহু সংখ্যক ইলাহর দাসত্ব করে কখনো তা লাভ করা যেতে পারে না।

এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, এটি জড় পদার্থ মূর্তি নয় বরং জীবন্ত মনিবদের বর্ণনা। মানুষ নিজের প্রবৃত্তির মধ্যে, বংশের মধ্যে, জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে, জাতি ও দেশের সমাজের মধ্যে, ধর্মীয় নেতার মধ্যে, শাসক ও আইন প্রণেতাদের মধ্যে, কায়কারবার ও জীবিকার গণ্ডির মধ্যে এবং পৃথিবীর সভ্যতার ওপর প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিসমূহের মধ্যে সর্বত্র বিদ্যমান। তাদের পরস্পর বিরোধী আকাক্সক্ষা ও বিভিন্ন দাবি মানুষকে সবসময় নিজের দিকে টানতে থাকে। সে তাদের যার আকাক্সক্ষা ও দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হয় সে তাকে নিজের কর্মের গণ্ডির মধ্যে শাস্তি না দিয়ে ছাড়ে না। তবে প্রত্যেকের শাস্তির উপকরণ ভিন্ন ভিন্ন। কেউ গালিগালাজ করে মনে আঘাত দেয়, কেউ সিরিয়াস অসন্তুষ্ট হয় ফলে তার বিরাগভাজন হতে হয়, কেউ উপহাস করে, কেউ সম্পর্ক ছিন্ন করে।

কেউ নির্বোধ বলে আখ্যায়িত করে, কেউ ধর্মের উপর আক্রমন করে, কেউ আইনের আশ্রয় নিয়ে শাস্তি দেয়। এমনটিও হয় যে, শারীরিকভাবে লাঞ্জিত করার মানসিকতাসম্পন্ন মাবুদ লক্ষ করা যায়। মানুষের জন্য এ সংকীর্ণতা বা লাঞ্জনা থেকে বাঁচার একটি মাত্র উপায় আছে। আর তা হচ্ছে, তাওহীদের পথ গ্রহণ করে শুধু এক আল্লাহর বান্দা হয়ে যাওয়া এবং গলদেশ থেকে অন্যদের দাসত্বের শৃংখল ছিঁড়ে দূরে নিক্ষেপ করা।

তাওহীদের পথ অবলম্বন করারও দু’টি পন্থা আছে এবং এর ফলাফলও ভিন্ন ভিন্ন। একটি পন্থা এমন যে, কেউ ব্যক্তিগত পর্যায়ে এক আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেবে কিন্তু আশে-পাশের পরিবেশ তার সহযোগী হবে না। এ ক্ষেত্রে তার জন্য বাইরের দ্বন্ধ-সংঘাত ও সংকীর্ণতা আগের চেয়েও বেড়ে যেতে পারে। তবে সে যদি সরল মনে এ পথ অবলম্বন করে থাকে তাহলে মনের দিক দিয়ে শান্তি ও তৃপ্তি লাভ করবে। সে প্রবৃত্তির এমন প্রতিটি আকাক্সক্ষা প্রত্যাখ্যান করবে যা আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী বা যা পূরণ করার পাশাপাশি আল্লাহভীরুতার দাবি পূরণ করা যেতে পারে না।

সে পরিবার, গোত্র, গোষ্ঠী, জাতি, সরকার, ধর্মীয় নেতৃত্ব এবং আর্থিক কর্তৃত্বেরও এমন কোন দাবি গ্রহণ করবে না যা আল্লাহর আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। এর ফলে সে সীমাহীন দু:খ-দুর্দশার সম্মুখীন হতে পারে তথা অনিবার্যরূপেই হবে কিন্তু তার মন এ ব্যাপারে পুরোপুরি পরিতৃপ্ত থাকবে যে, আমি যে আল্লাহর বান্দা তার দাসত্বের দাবি আমি সম্পূর্ণরূপে পূরণ করছি। আর আমি যাদের বান্দা নই আমার কাছে তাদের এমন কোন অধিকার নেই, যে কারনে আমি আমার রবের নির্দেশের বিরুদ্ধে দাসত্ব করবো। দুনিয়ার কোন শক্তিই তার থেকে মনের এ প্রশান্তি এবং আত্মার এ শান্তি ও তৃপ্তি ছিনিয়ে নিতে পারেনা। এমনকি তাকে যদি ফাঁসি কাষ্ঠেও চড়তে হয় তাহলে সে প্রশান্ত মনে ফাঁসির কাষ্ঠেও ঝুলে যাবে। সে এ কথা ভেবে সামান্য অনুশোচনাও করবে না যে, আমি কেন মিথ্যা প্রভুদের সামনে মাথা নত করে আমার জীবন রক্ষা করলাম না।

আরেকটি পন্থা এমন যে, গোটা সমাজ তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাক এবং সেখানে নৈতিক চরিত্র, সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্ম, আইন, কানুন, রীতিনীতি ও দেশাচার, রাজনীতি, অর্থনীতি মোট কথা জীবনের প্রতিটি বিভাগের জন্য আকীদা-বিশ্বাস হিসেবে সেসব মূলনীতি মেনে নেয়া হোক এবং কার্যত চালু করা হোক যা মহান আল্লাহ তাঁর কিতাব ও রাসুলের মাধ্যমে দিয়েছেন। আল্লাহর দীন যেটিকে গোনাহ বলবে আইন সেটিকেই অপরাধ হিসাবে গণ্য করবে, সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সেগুলোকে উৎখাত করার চেষ্টা করবে, শিক্ষা-দীক্ষা সেটি থেকে বাঁচার জন্য মন মানসিকতা তৈরি করবে। মিম্বার ও মিহরাব থেকে এর বিরুদ্ধেই আওয়াজ উঠবে সমাজ এটিকে দোষণীয় মনে করবে এবং জীবিকা অর্জনের প্রতিটি কাজ-কারবারে তা নিষিদ্ধ হবে। অনুরূপভাবে আল্লাহর দীন যে জিনিসকে কল্যাণ ও সুকৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করবে আইন তাকেই সমর্থন করবে। ব্যবস্থাপনার শক্তি তার লালন পালন করবে। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা মন মগজে সেটিকে বদ্ধমূল করতে এবং চরিত্র ও কর্মে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করবে। মিম্বার ও মেহরাব তারই শিক্ষা দিবে, সমাজও তারই প্রশংসা করবে। তার উপরই প্রচলিত রীতিনীতি কার্যত প্রতিষ্ঠিত করবে এবং কায়-কারবার ও জীবন জীবিকার প্রক্রিয়াও সে অনুসারেই চলবে। এভাবেই মানুষ পুর্ণ আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শান্তি লভ করে এবং বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উন্নতির সমস্ত দরজা তার জন্য খুলে যায়। কারণ, আল্লাহ ও গায়রুল্লাহর দাসত্বের দাবির যে দ্বন্ধ-সংঘাত তা তখন প্রায় শেষ হয়ে যায়।

ইসলাম যদিও প্রত্যেক ব্যক্তিকে এ বলে আহ্বান জানায় যে, দ্বিতীয় অবস্থাটা সৃষ্টি হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় সে তাওহীদকেই তার আদর্শ হিসেবে মেনে চলবে এবং সব রকম বিপদ-আপদ ও দু:খ-কষ্টের মোকাবিলা করে আল্লাহর দাসত্ব করবে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, ইসলামের চুড়ান্ত লক্ষ এ দ্বিতীয় অবস্থা সৃষ্টি করা। সমস্ত নবী ও রাসুল আলাইহিস সালামের প্রচেষ্টা ও দাবিও এই যে, একটি মুসলিম উম্মাহর উত্থান ঘটুক যারা কুফর ও কাফেরদের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে জামায়াতবদ্ধভাবে আল্লাহর দীন অনুসরণ করবে।

কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞ এবং বিবেক-বুদ্ধিহীন না হয়ে কেউ একথা বলতে পারে না যে, নবী রাসুল আ: এর চেষ্টা সাধনার লক্ষ ছিল শুধু ব্যক্তিগত ঈমান ও আনুগত্য। সামাজিক জীবনে ‘দীনে হক’ বা ন্যায় ও সত্যের আদর্শ কায়েম করার উদ্দেশ্য আদৌ তাঁদের ছিল না।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তিনিই সে মহান সত্তা যিনি তাঁর রাসুলকে হিদায়াত এবং ‘দীনে হক’ দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ দীনকে অন্য সকল দীনের ওপর বিজয়ী করেন, চাই তা মুশরিকদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন।”(সুরা সফ:৯) এর আগে সুরা তাওবার ৩৩ নং আয়াতে এবং সুরা ফাতহের ২৮ নং আয়াতে একই ঘোষনা এসেছে। সারা কুরআনে এ দ্বিতীয় বিষয়টিই অধিকহারে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ একটি সোনালী সমাজ বিনির্মাণের বাধ্যতামূলক তাগিদ।

আয়াতগুলোতে “আদ দীন’ দ্বারা দ্বিতীয় অবস্থাটি বুঝানো হয়েছ্।ে আরবী ভাষায় দীন বলতে এমন একটি জীবন ব্যবস্থা বা জীবন পদ্ধতি অর্থে ব্যবহৃত হয় যার প্রতিষ্ঠাতাকে সনদ ও অনুসরণযোগ্য বলে মেনে নিয়ে তার আনুগত্য করতে হয়। কাজেই আয়াতে রাসুল পাঠাবার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলা হয়েছে দীন জাতীয় বা দীনের শ্রেনীভুক্ত অন্য কথায় জীবন বিধান পদবাচ্য সমস্ত পদ্ধতি ও ব্যবস্থার ওপর জয়ী করবেন। অন্য কথায় রাসুলে কখনো এ উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়নি যে, তিনি যে জীবন ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন তা অনান্য জীবনব্যবস্থার কাছে পরাজিত হয়ে ও সেগুলোর পদানত থেকে তাদের দেয়া সুযোগ সুবিধা ভোগ করার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ ও সংকোচিত করে রাখবে। অথবা অন্যান্য জীবনব্যবস্থার সাথে সমান সমান সুযোগ সুবিধা নিয়ে পাশাপাশি অবস্থান করবে। বরং তিনি আকাশ ও পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতির প্রতিণিধি হয়ে আসেন এবং নিজের মনিবের সত্য ও ন্যায়ের ব্যবস্থাকে বিজয়ী দেখতে চান। দুনিয়ায় যদি অন্য কোন জীবন ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকে তাহলে তাকে আল্লাহর ব্যবস্থার আওতাধীনেই তার দেয়া সুযোগ-সুবিধা হাত পেতে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। যেমন জিজিয়া আদায় করার মাধ্যমে যিম্মিরা নিজেদের অধীনতার জীবন মেনে নেয়।

সুরা সফ : ৯), সুরা তাওবার ৩৩ ও সুরা ফাতহের ২৮ নং আয়াতগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোতে ইসলামী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। তাই আয়াতগুলো পড়ার সময় অমনোযোগী হওয়া উচিত নয়। বরং এর অর্থ ও প্রতিপাদ্য বিষয়টি ভালভাবে বুঝার চেষ্টা করা উচিত এবং নিজের জীবনের লক্ষ-উদ্দেশ্য এ আয়াতগুলোর আলোকে নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় জীবনের কোন না পর্যায়ে নিজেকে শিরকের সাথে জড়িয়ে ফেলার সমুহ সম্ভবনা রয়েছে। তাই দীন বা জীবনব্যবস্থাকে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য সুনির্দিষ্ট করতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এবং নিজের দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্য করে নিয়ে তাঁকেই ডাকো।” (সুরা আরাফ : ২৯) “আমাকে মু’মিনদের অন্তরভুক্ত হবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর আমাকে বলা হয়েছে, তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে ঠিকভাবে এ দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত করো। এবং কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কোন সত্তাকে ডেকো না, যে তোমার না কোন উপকার করতে পারে। যদি তুমি এমনটি করো তাহলে জালেমদের দলভুক্ত হবে।” (সুরা ইউনুস : ১০৫-১০৬) “কাজেই (হে নবী এবং নবীর অনুসারীবৃন্দ) একনিষ্ঠ হয়ে নিজের চেহেরা এ দীনের দিকে স্থির করে দাও। আল্লাহ মানুষকে যে প্রকৃতির ওপর সৃষ্টি করেছেন তার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও।” (সুরা রুম : ৩০) “সাবধান! একনিষ্ঠ ইবাদাত কেবল আল্লাহরই প্রাপ্য।” (সুরা যুমার : ৩) “(সুতরাং হে প্রত্যাবর্তনকারীরা) দীনকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট কওে তাঁকেই ডাকো, তোমাদের এ কাজ কাফেরদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন।” (সুরা মু’মিন : ১৪)

লেখক : ব্যাংকার।