আপন প্রয়োজনেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে। উন্নত জীবনযাপনের জন্য মানুষ গঠন করেছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ করবে, বৈষম্য দূর করবে, বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেবে। এ বিষয়গুলো রাষ্ট্রের শাসকরা বারবার উচ্চারণ করে থাকেন, কিন্তু কথা ও কাজে মিল থাকে কম। ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার তারতম্যের কারণে রাষ্ট্রে সব নাগরিক সমান সুযোগ পায় না। সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের শুধু বঞ্চিত করে না, নির্যাতনও করে। ক্ষমতার লোভে শাসকরা এমন অন্যায়কে শুধু সমর্থনই করে না, পৃষ্ঠপোষকতাও দেয়। প্রসঙ্গত প্রতিবেশি দেশ ভারতের কথা উল্লেখ করা যায়। দেশটির সংবিধানে তো ‘বৈচিত্র্যের ঐক্যের’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিজেপি আমলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে উল্টো বিষয়। ঐক্যের বদলে বিদ্বেষের বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে মুসলমানদের নাগরিক অধিকার থেকেই শুধু বঞ্চিত করা হচ্ছে না, দেশ থেকে তাড়াবার ব্যবস্থাও জারি রয়েছে। উগ্রহিন্দুত্ববাদের কারণে দেশটিতে মুসলমানদের বসবাস কঠিন হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিককালে ভারতের মুসলমানদের বাংলাদেশে পুশইন করার একটি মন্দ কৌশল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কলকাতা হাইকোর্টের এক আদেশেও বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের পরিযায়ী দু’শ্রমিক পরিবারকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ খারিজ করে দিয়েছেন কলকাতা হইকোর্ট। গত শুক্রবার আদালত এক আদেশে বলেছেন, ‘খুব তাড়াহুড়া করে তাদের ভারত থেকে বিতাড়ন করা প্রক্রিয়ার স্পষ্ট লঙ্ঘন। এ কর্মকা- বিতাড়নের সরকারি আদেশকে আইনি ভুল প্রমাণ করে এবং এটি বাতিলযোগ্য।’ উল্লেখ্য, চলতি বছরের শুরুর দিকে দু’মুসলিম পরিবারকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে বলে জানানো হয়েছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তী ও বিচারপতি ঋতব্রত কুমার মিত্রের একটি ডিভিশন বেঞ্চ শুক্রবার নির্দেশ দিয়েছেন, আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা সোনালি খাতুনসহ (বিবি) দু’পরিবারের ছয় সদস্যকে চার সপ্তাহের মধ্যে পশ্চিবঙ্গে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ আদশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আবেদনও খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। আদেশে বলা হয়েছে, ‘নাগরিকত্বের প্রশ্নটি আরও নথিপত্র ও প্রমাণের ভিত্তিতে উপযুক্ত একটি আদালতে বিবেচনা করা উচিত। বিতাড়নের ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, তাই এ সন্দেহ তৈরি করেছে যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে কাজ করতে গিয়ে ২ মে ২০২৫-এর মেমোর বিধিবিধান সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছে।’

হাইকোর্টের বেঞ্চ মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা ওইসব ব্যক্তিকে ভারতে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছি। তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য কী পদক্ষেপ নিতে হবে, তা আমরা বলে দিয়েছি। সরকারকে চার সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে।’ এখন দেখার বিষয় হলো, ভারত সরকার সোনালি খাতুনসহ দ্’ুপরিবারের ছয় সদস্যের সাথে কেমন আচরণ করে। আদালত তাদের ভারতে ফিরিয়ে আনার জন্য চার সপ্তাহ সময় দিয়েছেন। এ সময়সীমা মান্য করলে মঙ্গল। আদালত তো ন্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে তার কাজ সম্পাদন করেছেন। কিন্তু সরকার সবসময় তা করে না। নরেন্দ্র মোদির আমলে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্যায়-অবিচার খুবই পরিচিত বিষয়। কিন্তু দুর্বলরা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সামর্থ্য রাখে না। সোনালি খাতুনদের ভাগ্য ভালো, কিছু মানুষ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, আদালতে তারা সুবিচার পেয়েছে। কিন্তু সবাই আদালতে যাওয়ার সাহস ও সামর্থ্য রাখে না। জুলুম-নির্যাতন ও বঞ্চনা তাদের ভাগ্যলিপি হয়ে থাকে। এ কারণেই প্রয়োজন সুশাসন। সুশাসন কারো চেহারা দেখে না, ধর্ম দেখে না। সুশাসনে বৈষম্য নেই। এর অভাবেই ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানরা শোষিত-বঞ্চিত। নাগরিক হওয়ার পরও তারা অধিকার বঞ্চিত। তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়। ভারতের এ পুশইন বাংলাদেশের জন্য এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোনালি খাতুনদের ভাগ্য ভালো, আদালত তাদের ভারতে ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সবার তো এমন সৌভাগ্য হয় না। তাই দেশের সরকারকে নীতি ও নৈতিকতার পথে চলা প্রয়োজন। ভ্রষ্টপথে চললে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। ভ্রষ্ট সরকারের কোনো প্রয়োজন আছে মানুষের?