প্রচার, অপপ্রচার, রটনা-কত শব্দ আমাদের বাংলাভাষায়। শব্দ তো ভাব প্রকাশ করে। ভাবের তারতম্যের কারণে শব্দে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। একেক শব্দ একেক ভাবকে বহন করে চলে। ‘উগ্রবাদ’, ‘বর্ণবাদ’, ‘বিদ্বেষ’Ñএগুলো কোনো ভালো শব্দ নয়। কারণ, এগুলো মন্দভাবের বাহক। লক্ষণীয় বিষয় হলো, বর্তমান সভ্যতায় শব্দগুলোর অপপ্রয়োগ হচ্ছে। সবাইতো অপপ্রয়োগের সামর্থ্য রাখে না। যারা শক্তিমান তারাইতো এখন ভাষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগের কারিগর। গত শতাব্দীর শেষের দিকে হঠাৎ করে আমরা পাশ্চাত্যের মিডিয়ায় কিছু শব্দের বহুল প্রচার লক্ষ্য করি। পরবর্তী সময়ে আমাদের মিডিয়াগুলোতেও ওই শব্দগুলো জায়গা করে নেয়। তবে ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে যে, কিছু শব্দের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বহুল প্রচার আসলে ভূরাজনীতিরই অংশ। রটনার গুণে ‘মৌলবাদ’ ও ‘উগ্রবাদকে’ সমার্থক করে তোলা হয়। আর এর প্রধান শিকার হয় মজলুম মুসলিমরা। এছাড়া বর্ণবিদ্বেষ ও ইসলামবিদ্বেষের আক্রমণতো আছেই। ফলে বলা চলে, বর্তমান সভ্যতায় বহুবিধ প্রোপাগাণ্ডা বা রটনার শিকার হচ্ছেন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষরা।

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস নগরে আগামী নবেম্বরে অনুষ্ঠেয় মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৩৫ বছর বয়সী যুবক ওমর ফাতেহ। তবে সোমালীয় বংশোদ্ভূত এ কৃষ্ণাঙ্গ প্রার্থীকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রভাবশালী ডানপন্থীরা শুরু করেছেন নানা অপপ্রচার। তার নাগরিকত্ব নিয়ে ভিত্তিহীন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এছাড়া বর্ণবিদ্বেষী ও ইসলামবিদ্বেষী আক্রমণের শিকার হচ্ছেন ওমর ফাতেহ। উল্লেখ্য, ওমর ফাতেহ ২০২০ সাল থেকে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের আইনসভার উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির এ সদস্য ২০২৪ সালের ২ ডিসেম্বর থেকে মিনিয়াপোলিসের মেয়র পদে প্রার্থী হিসেবে প্রচার কাজ শুরু করেন। তবে চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে ওমর ফাতেহ ব্যাপক বর্ণবিদ্বেষী ও ইসলামবিদ্বেষী আক্রমণের মুখে পড়েছেন বলে জানায় মিডল ইস্টআই।

চলতি সপ্তাহের শুরুতে ডানপন্থী অ্যাকটিভিস্ট ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ’-এর প্রতিষ্ঠাতা চার্লি কার্ক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘মুসলিমদের আদেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন যে দেশে থাকে, সে দেশের সরকারের ক্ষমতা দখল করে নেয়।’ একই পোস্টে কার্ক অভিযোগ করেছেন, গণহারে অভিবাসনের সুযোগ নিয়ে ভিনদেশি মুসলিমরা এমনটা করছে। চার্লিকার্ক একাধিকবার ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বর্ণবাদেরও চ্যাম্পিয়ন। ২০২০ সালে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার হাতে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডকে ‘জঘন্য মানুষ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। কার্ক মেয়র প্রার্থী ওমর ফাতেহকে নিয়ে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ‘তৃতীয় বিশ্বের মানুষের অভিবাসন বন্ধ’ করার আহ্বানও জানাচ্ছেন তিনি। কার্কের দেখাদেখি আরও অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওমর ফাতেহকে আক্রমণ শুরু করেন। কেউ কেউ তো সোমালিদের কীভাবে দেশে ফেরত পাঠানো যায়, তা নিয়েও আলাপ শুরু করেছেন। হঠাৎ করে এমন বিদ্বেষী প্রচারের জবাবে নিজের ব্যক্তিগত এক অ্যাকাউন্টে ফাতেহ লিখেছেন, মিনিয়াপোলিস এক দারুণ বৈচিত্র্যময় শহর, যেখানে আমরা আমাদের প্রগতিশীল মূল্যবোধে অটল থাকি। আজকাল প্রায়ই যে বিদ্বেষ আমি দেখছি, সেটা ঠিক আমাদের সঙ্গে যায় না।’ অবশ্য এ বিদ্বেষের বিপরীতে অনেকে আবার ফাতেহ-এর পাশেও দাঁড়িয়েছেন এবং মেয়র প্রার্থী হওয়ায় তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, ওমর ফাতেহের জন্ম ওয়াশিংটন ডিসিতে। তার বাবা-মা সোমালিয়ার অভিবাসী। উগ্রবাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী আচরণ এখন যুক্তরাষ্ট্রে স্পষ্ট। এদেরকে সাম্প্রদায়িক হিসেবেও অভিযুক্ত করা যায়। এদের অভিবাসীবিরোধী বয়ানও বিশ্লেষণ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র তো আসলে অভিবাসীদেরই একটি দেশ। কেউ এদেশে একটু আগে এসেছেন, কেউবা একটু পরে। শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরাতো আদিবাসীদের উচ্ছেদের কর্ম সম্পাদন করেছেন। এখন তো প্রায় সবাই অভিবাসী। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ‘অভিবাসী’ বিষয়টা কোনা সমস্যা নয়, সমস্যা হলো বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ।