আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ৮১টি দেশীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাকে চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন দিয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করতে এ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ ঘোষণার পাশাপাশি আরও বড় প্রশ্নটি উঠে আসে-এই পর্যবেক্ষকরা কতটা যোগ্য, কতটা প্রশিক্ষিত এবং কতটা নিরপেক্ষ?
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ শুধু নির্বাচনী কেন্দ্র ঘুরে দেখা বা কিছু ফরম পূরণ করার আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়া। ভোটার উপস্থিতি, প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের সমান সুযোগ পাওয়া, প্রশাসনের ভূমিকা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাÑসবকিছু মূল্যায়ন করেই একটি নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ‘গ্রহণযোগ্য’ বলা হয়। সেই মানদণ্ড পূরণে পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা অপরিহার্য। গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে দুই ধাপে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন যে স্বচ্ছতা ও পদ্ধতিগত দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। দাবি-আপত্তি গ্রহণ, অভিযোগ নিষ্পত্তি, প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ এবং শেষ পর্যন্ত দুটি ধাপে ৮১টি সংস্থাকে নিবন্ধন-সব মিলিয়ে এটি একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত দেয়। তাছাড়া ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা ২০২৫’-এর ধারা মোতাবেক পূর্ববর্তী ৯৬টি সংস্থার নিবন্ধন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হওয়া একটি সাহসী ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত।
নির্বাচন কমিশন ৮১টি দেশীয় সংস্থাকে নিবন্ধন দিলেও অতীত অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, সংখ্যা বেশি হলেই পর্যবেক্ষণের মান বাড়ে না। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে যেখানে ১৩৮টি সংস্থার অংশগ্রহণ ছিল, আগে-পরে কয়েকটি নির্বাচনে সেই সংখ্যার তুলনায় অংশগ্রহণ কমলেও গুণগত মান ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আবার ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের সংখ্যা যথেষ্ট হলেও বিতর্ক, পক্ষপাত ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
একটি পর্যবেক্ষক সংস্থা সত্যিকারের মূল্য রাখে তখনই, যখন তার মাঠপর্যায়ের সদস্যরা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ হন, প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ হন, স্বাধীনভাবে কেন্দ্র পরিদর্শনে সক্ষমতা লাভ করেন, অভিযোগ লিপিবদ্ধ ও রিপোর্ট তৈরি করতে দক্ষতা অর্জন করেন এবং সর্বোপরি চাপমুক্তভাবে মতামত জানাতে পারে। আর যদি কোনো সংস্থা কাগজে-কলমে নিবন্ধিত হয়, কিন্তু বাস্তবে মাঠে সক্রিয় না হয় বা রিপোর্টে সততার অভাব থাকেÑতবে তাদের উপস্থিতির চেয়ে অনুপস্থিতিই বরং দেশের জন্য ভালো।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম; সেই সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের উত্তাপ, সন্দেহ ও প্রতিযোগিতা। এমন পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের ভূমিকা দ্বিমুখী। একটি হলো, অভ্যন্তরীণ আস্থা তৈরি করা, আর অপরটি হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এখানে মনে রাখতে হবেÑ যে কোনো নির্বাচন শেষে জনগণ ও রাজনৈতিক দল যদি পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদনের ওপর আস্থা রাখতে না পারে, তবে সেই নির্বাচন যতই শান্তিপূর্ণ হোক, গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অতএব পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণ বস্তুনিষ্ঠ থাকবে এবং প্রতিবেদনে কোনো গোপন উদ্দেশ্য বা দলীয় ঝোঁক থাকবে না-এমনটাই সবার প্রত্যাশা।
নিবন্ধন দেওয়া ইসির দায়িত্বের মাত্র প্রথম অংশ। এর পর আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্ব রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পর্যবেক্ষকদের বাধাহীন চলাচলের নিশ্চয়তা প্রদান করা, মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করা, সংস্থাগুলোর নিয়মিত মূল্যায়ন করা, অযোগ্য সংস্থাকে বাদ দেওয়া ও যোগ্যদের উৎসাহ দেওয়া আর সর্বশেষ প্রতিবেদন তৈরির নির্ধারিত কাঠামো ও সময়সীমা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া ভোটের দিন ও আগে-পরে পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়াও প্রয়োজন।
নির্বাচনে শুধু ইসির নয়, রাজনৈতিক দলগুলোরও বড় ভূমিকা রয়েছে। তারা যদি পর্যবেক্ষকদের কাজ করতে সহযোগিতা করে, কেন্দ্রে স্বচ্ছ পরিবেশ তৈরি হয়, আর দলীয়ভাবে পর্যবেক্ষকদের ওপর চাপ সৃষ্টি না করা হয়Ñতবে পর্যবেক্ষণ আরো কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য হবে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন কোনোভাবেই বিতর্কিত না হয়, বরং আস্থার নির্বাচনে পরিণত হয়-সেই প্রত্যাশা থেকেই যোগ্য, প্রশিক্ষিত ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের সুযোগ দিতে হবে। শুধু সংস্থার সংখ্যা বাড়লেই হবে না বরং মান, সততা ও পেশাদারিত্বই যেন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায় তাও নিশ্চিত করতে হবে।