সাম্প্রতিক ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকাবাসীকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে-আমরা একটি ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ দেশে বাস করি। নরসিংদীর মাধবদীকে উৎপত্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত এ ভূকম্পন ছিল সাম্প্রতিক দশকগুলোর মধ্যে ঢাকায় অনুভূত সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প। ভূমিকম্পে বড় ক্ষয়ক্ষতি না হলেও এর পরপরই যে আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে-তা আমাদের দুর্বল প্রস্তুতি ও অবকাঠামোগত ঝুঁকিকে নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মাত্রা আরও একটু বেশি হলে রাজধানীর পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারত। ঢাকা শহরে প্রায় ২১ লাখ ভবনের যেগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ নকশা-বহির্ভূত এবং ৩৫ শতাংশ ভবন বড় ভূমিকম্পে ধসে পড়ার ঝুঁকিপূর্ণ-এ তথ্য কোনোভাবেই আশাব্যঞ্জক নয়। ২০০৯ সালের আইডিএমপি-জাইকার জরিপে দেখা গেছে, ৭ মাত্রা বা তার বেশি ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আরও ১ লাখ ৩৫ হাজার। ধ্বংসস্তূপের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭ কোটি টন। এ সংখ্যাগুলো সম্ভাব্য দুর্যোগের ভয়াবহতা বুঝিয়ে দেয়।

আরো গুরুতর আশঙ্কা তৈরি করে গ্যাস লাইন। ফায়ার সার্ভিস ইতোমধ্যে সতর্ক করেছে- ঢাকার ৭৬ শতাংশ সরু রাস্তা উদ্ধারকাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, আর দুর্বল অবকাঠামো ও পুরনো গ্যাস লাইনগুলো বড় ভূমিকম্পে পরিণত হতে পারে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের মহাবিপর্যয়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্যাস লিকেজ ও বিস্ফোরণের যে প্রবণতা বেড়েছে, সেটিই বড় কম্পনে ভয়াবহতার স্কেলকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেনÑ শুধু ভূমিকম্পই নয়, গ্যাস লাইনের দুর্বলতা, ক্ষয়প্রাপ্ত পাইপ, সঠিক সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকা এবং প্রজ্বলন উৎসের উপস্থিতিÑ সব মিলিয়ে একটি বড় বিপর্যয়ের সম্ভাবনা সবসময় আমাদের ঘিরে থাকে।

ভূমিকম্প থামানো যায় নাÑ কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়। উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদেরও গ্রহণ করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিশেষ করে আমাদের অবকাঠামোগুলো শক্তিশালী করতে হবে। পুরনো ভবন ও গ্যাস লাইন আপগ্রেড করতে হবে বৈজ্ঞানিকভাবে। ভূমিকম্প মুহূর্তেই গ্যাস প্রবাহ বন্ধ করতে পারে-এমন প্রযুক্তি দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। ক্ষয়প্রাপ্ত পাইপলাইন ও দুর্বল সংযোগ দ্রুত প্রতিস্থাপন করতে হবে। ভূমি স্থানচ্যুতির সময় গ্যাস পাইপ যাতে না ফেটে যায়, সেজন্য আধুনিক সংযোগ ব্যবস্থার ব্যবহার করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মানুষই প্রথম প্রতিরক্ষাব্যূহ- তাই তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

এবারের ভূমিকম্পের ঠিক পরপরেই ‘দু’ঘণ্টার মধ্যে বড় কম্পন হবে’-এমন গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফলে নরসিংদী, বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্কে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। অথচ বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর পরিষ্কার জানিয়েছে-ভূমিকম্প আগাম পূর্বাভাস দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা বিজ্ঞানে নেই। ৫.৭ মাত্রার কম্পনটিকেই মূল কম্পন বা মেইন শক হিসেবে বিবেচনা করেছে বিএমডি, আর পরে হওয়া ছোট কম্পনগুলো স্বাভাবিক আফটার শকÑএগুলোর মাত্রা সাধারণত কম হয় এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই থেমে যায়। যদিও বাস্তবসম্মত কারণেই আবহাওয়া অধিদপ্তরের এসব আশ্বাসের ওপর নগরবাসী খুব বেশি আস্থা রাখতে পারছে না।

ভূমিকম্প আমাদের থামাতে পারবে না, কিন্তু সতর্ক সংকেত দেয়। সাম্প্রতিক কম্পনটি সে সংকেতকে নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের সরকারকে অবিলম্বে পুরনো অবকাঠামো সংস্কারে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। উদ্ধার ও জরুরি সেবার সামর্থ্য উন্নত করতে হবে। গ্যাস-লাইন নিরাপত্তায় শিথিলতা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি, জনগণেরও দায়িত্বÑ গুজবে কান না দেওয়া, সচেতন থাকা এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে চলা। বাংলাদেশ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলেÑএ বাস্তবতা বদলানো যাবে না। কিন্তু আমরা চাইলে আমাদের ভবনগুলোকে নিরাপদ করতে পারি, গ্যাস লাইনের ঝুঁকি কমাতে পারি, উদ্ধার সক্ষমতা বাড়াতে পারি, আর জনগণকে সচেতন করতে পারি। প্রকৃতি যখন সতর্ক করেÑতখন উদাসীনতা ভবিষ্যতের বড় বিপর্যয় ডেকে আনে। এখনই সময় প্রস্তুতি নেওয়ার। দেশের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের জন্য এটিই আমাদের সবার যৌথ দায়িত্ব।