বাজারে ভোজ্য তেলের দাম আবারও বেড়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গ্রীন সিগন্যালেই লিটার প্রতি ছয় টাকা দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি, সবজি, মাছসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও চড়েছে। সাধারণ মানুষের সংসার চালানো এখন ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষদের অবস্থা আরও শোচনীয়। একদিকে আয় বাড়ছে না, অন্যদিকে প্রতিদিনের বাজারে খরচ লাগামহীনভাবে বাড়ছে। ভোজ্য তেল এমন একটি পণ্য, যার প্রভাব পুরো বাজার ব্যবস্থার ওপর পড়ে। রান্নার প্রায় প্রতিটি ধাপে এটি অপরিহার্য। তেলের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবে হোটেল, রেস্তোরাঁ, এমনকি গৃহস্থালি পর্যায়েও খরচ বাড়ে; এর প্রতিক্রিয়া পড়ে খাদ্যদ্রব্যের দামেও। তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে ওঠানামা থাকলেও দেশের বাজারে দাম বৃদ্ধির হার প্রায়ই অযৌক্তিক এবং সমন্বয়হীন বলে মনে হয়।
প্রশ্ন হলো-বাজার নিয়ন্ত্রণ কোথায়? সরকারি সংস্থা, বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ)-এর ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই কাগুজে সীমায় আটকে আছে। নিয়মিত বাজার মনিটরিং, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
অভ্যন্তরীণ বাজারে অস্থিরতার পেছনে প্রভাবশালী কিছু আমদানিকারক ও মজুদদারদের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। বরাবরের মতো তারা আন্তর্জাতিক বাজারে সামান্য পরিবর্তন দেখেই বড় অজুহাত তৈরি করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিশ্ববাজারে যখন দাম কমে, তখন কেন দেশের বাজারে তার প্রতিফলন দেখা যায় না? সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় বাজারে হঠাৎ বৃদ্ধি অস্বাভাবিক। এটি ইঙ্গিত দেয় যে বাজারে নিয়ন্ত্রণহীনতা ও সমন্বয়হীনতা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশের বাজারে এক দীর্ঘদিনের সমস্যা হলোÑনীতিগত অস্পষ্টতা। কখনও হঠাৎ করে আমদানি শুল্ক বাড়ানো, কখনও সীমান্তে নতুন নীতিমালা জারিÑএসব পরিবর্তনে বাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। সরকার যদি ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও আমদানিকারকদের মধ্যে সমন্বিত সংলাপ চালু রাখতে পারে, তাহলে নীতিগত স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। এছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় ঘাটতি হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। যখন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত থাকে, তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ জনগণের স্বার্থে সরকারকে এই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এখন প্রয়োজন : ১. কার্যকর বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা: প্রতিদিনের ভিত্তিতে জেলা ও মহানগর পর্যায়ে দাম পর্যবেক্ষণ ও প্রকাশ। ২. সিন্ডিকেট বিরোধী অভিযান জোরদার করা এবং অনিয়ম প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। ৩. টিসিবির কার্যক্রম সম্প্রসারণ করে নিম্নআয়ের মানুষের নাগালে ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। ৪. সরকারি নীতিগত স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি, যাতে ব্যবসায়ীরা অনৈতিক সুযোগ নিতে না পারে।
স্মরণ রাখা দরকার, বাজারে অস্থিরতা কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়-এটি সামাজিক অস্থিরতারও কারণ। যখন একজন শ্রমজীবী মানুষ তার পরিবারকে তিনবেলা আহার দিতে পারে না, তখন ক্ষোভ ও হতাশা সমাজে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। তাই সরকারের প্রতি আহ্বান-বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা যেন কেবল ঘোষণায় সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং তা যেন মাঠপর্যায়ে বাস্তব ফল বয়ে আনে।
এমতাবস্থায় দরকার একটি সমন্বিত বাজার নীতিমালা, যেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ও টিসিবি যৌথভাবে কাজ করবে। শুধু কাগুজে পরিকল্পনা নয়, প্রতিদিনের বাস্তব প্রয়োগে ফলাফল দৃশ্যমান হতে হবে। কারণ, দেশের বাজার স্থিতিশীলতা মানেই অর্থনীতির স্থিতিশীলতা; আর অর্থনীতির স্থিতিশীলতা মানেই সাধারণ মানুষের মুখে স্বস্তির হাসি।