গাজা উপত্যকা আজ মানব ইতিহাসের এক ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয়ের নাম। ইসরাইলী সেনাবাহিনীর ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সামরিক আগ্রাসনে ফিলিস্তিনীদের ওপর চলমান গণহত্যায় এখন পর্যন্ত ৫৭,৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি। এ ভয়াল নিধনযজ্ঞের পটভূমিতে কাতারে অনুষ্ঠিত হামাস ও ইসরাইলের মধ্যকার পরোক্ষ যুদ্ধবিরতি আলোচনা ব্যর্থ হওয়াটা গভীর উদ্বেগ ও শঙ্কার জন্ম দেয়।

আলোচনায় অংশগ্রহণকারী দু’টি ফিলিস্তিনী সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, কাতারে অনুষ্ঠিত প্রথম দফার আলোচনা কোনো অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেনÑইসরাইলী প্রতিনিধিদের কাছে চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছানোর যথাযথ ক্ষমতা দেয়া হয়নি এবং ইসরাইলী কর্তৃপক্ষের দিক থেকে রাজনৈতিক সদিচ্ছারও ঘাটতি রয়েছে। হামাস কিছু শর্ত সংশোধনের মাধ্যমে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করলেও ইসরাইল আবারও সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি যে কতটা বিপজ্জনক, তা গাজার ধ্বংসস্তূপ ও মৃত শিশুদের দেহের সংখ্যা দেখলেই স্পষ্ট হয়।

একদিকে যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানিয়ে একের পর এক উদ্যোগ নিচ্ছে, অন্যদিকে ইসরাইল যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জেদের বাইরে কিছু ভাবছে না। প্রতিদিন গাজায় শিশুরা বোমায় ঝলসে যাচ্ছে, হাসপাতাল ধ্বংস হচ্ছে, খাদ্য ও পানির সংকটে মানুষ মরছে। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা ও অসংখ্য দেশ যুদ্ধবিরতির দাবিতে সোচ্চার হলেও যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহু সরকারের মনোভাব রীতিমতো নিষ্ঠুর ও অমানবিক।

এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য কিছুটা আশার সঞ্চার করলেও বাস্তবতার নিরিখে তা এখনও এক অস্পষ্ট রাজনৈতিক আশ্বাস মাত্র। তিনি দাবি করেছেন, “এ সপ্তাহেই হামাসের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।” কিন্তু প্রশ্ন হলোÑএ কথার পেছনে কার্যকর কোনো উদ্যোগ আছে কি? যখন ইসরাইলী প্রতিনিধিদলকে নিজেদের পক্ষ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি, আগেরবারের যুদ্ধবিরতি লংঘনের জন্য ইসরাইলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি এবং আগামীতেও যুদ্ধবিরতি হলে ইসরাইল লংঘন করবে না-সে নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বাস্তবিক অর্থেই আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

গাজা যদি এভাবেই রক্তস্নাত থাকে এবং কোনো যুদ্ধবিরতি না হয়, তাহলে একে “মৃত্যুপুরী” বলে আখ্যায়িত করাটা কোনো অলঙ্কারিক ভাষা নয়Ñএটাই বাস্তব। খাদ্য, ওষুধ, পানীয় জল ও আশ্রয়ের সংকটে পিষ্ট গাজার মানুষ এখন মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। শরণার্থী শিবিরগুলো পর্যন্ত আর নিরাপদ নয়। শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বোমা বর্ষণ হয়েছে। শিশুদের জন্য এখন আর স্কুল নেই, কেবল ধ্বংসস্তূপ আর কবরস্থান। এ পরিস্থিতিতে আমাদের মতপ্রকাশের দায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা, মুসলিম বিশ্ব এবং বিবেকবান রাষ্ট্রগুলোর উচিত, অবিলম্বে ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যুদ্ধবিরতির চুক্তি কার্যকর করা। যুদ্ধ থামানোর এ চেষ্টা শুধু কূটনৈতিক স্তরে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে নাÑএর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক শক্তি, গণআন্দোলন এবং মানবিক চেতনার পূর্ণ উদ্ভাস।

গাজা যেন আরেকটি শেবরেনিকা বা রুয়ান্ডা না হয়। ইতিহাসের দায় এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। যদি এখনই যুদ্ধ বন্ধ না হয়, তাহলে খুব শিগগিরই গাজার মানচিত্র একটি বিশাল গণকবরের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হবেÑযার দায় জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ওআইসি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রÑসবাইকে নিতে হবে। ইসরাইল যদি সত্যিই শান্তি চায়, তাহলে তাকে যুদ্ধবিরতির টেবিলে পূর্ণ সদিচ্ছা নিয়ে ফিরে আসতে হবে। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রকৃত অর্থে মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ায়, তাহলে ইসরাইলের এ নৃশংস অভিযান বন্ধে কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে হবেÑসরাসরি এবং স্পষ্টভাবে।

আমরা আশা করি, এ ভয়াবহ মানবিক সংকটে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হবে এবং গাজায় একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে রক্তপাত বন্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।