ফেব্রুয়ারি, মার্চ, ডিসেম্বরের মতো জুলাই মাসটাও আমাদের জাতীয় জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময়টা ছিল ঐতিহাসিক। ঘটনাবহুল সে সময়ের কথা ভাবতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের রক্তঝরা সহাসী দিনগুলো আমাদের জাতীয় জীবনের অহঙ্কার হিসেবে বিবেচিত হবে। ২০২৫ সালের ১ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হলো। বছর পূর্তিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগবে, আত্মসমালোচনা হবে। পিছনে তাকানোর পাশাপাশি সামনে এগোবার শপথও থাকবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এখন কথা, আলোচনা, লেখালেখি সবই হচ্ছে। তবে সবাই যে একরকম কথা বলছেন কিংবা ভাবছেন তা কিন্তু নয়। লক্ষ্য করা যাচ্ছে মতবৈচিত্র্য, মতপার্থক্য এবং কিছুটা কটূ ভাষণও। এমন উদাহরণে আমরা আশাবাদী হই, কারণ এগুলো একটি প্রাণবন্ত ও জীবন্ত জাতির বৈশিষ্ট্য। তবে এখানে রকমফেরও আছে। যারা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বোধ-বিশ্বাস ও আশা-আকাক্সক্ষা উপলব্ধিতে অক্ষম, বরং অবস্থান করছেন বিপরীত মেরুতেÑ তারা এখন অবগুণ্ঠন উন্মোচন করতে শুরু করেছেন। মতপার্থক্যের সীমানা অতিক্রম করে তারা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করেছেন। সময়ের সাথে সাথে তাদের মুখোশ আরো উন্মোচিত হবে। শুধু রাজনীতির মাঠে নয়, প্রশাসনে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, গণমাধ্যমে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তারা তৎপর রয়েছেন। আর ভূরাজনীতির বিষয়টাও এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বিষয়টা জাতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে।
আমরা জানি, গত বছরের পহেলা জুলাই শুরু হওয়া আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পুরো আন্দোলনে অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিলেন, মো. নাহিদ ইসলাম। ১ জুলাই দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে তার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। প্রশ্নের আলোকে অনেক বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আমাদের আকাক্সক্ষাটি ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে, কিন্তু ব্যবস্থার পতন বা বিলোপ ঘটেনি। সে ব্যবস্থা এখনো রয়ে গেছে। সে ব্যবস্থার রাজনৈতিক নেতৃত্ব সরে গেছে, আরেকটা রাজনৈতিক নেতৃত্ব সে ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। কিন্তু আমাদের লড়াইটা সে ব্যবস্থার সঙ্গে। পুরনো ব্যবস্থাকে ভাঙতে বা পরিবর্তন করতে হবে। সে জায়গায় আসলে অর্জন হয়নি এখনো। বৈপ্লবিক দায়িত্বটা পালন হয়েছে, কিন্তু গঠনটা আমরা এখনো করতে পারিনি। অনেকে জুলাই অভ্যুত্থানকে কেবল সরকার পতনের একটা ঘটনা হিসেবে দেখেন। তাদের কাছে তো আওয়ামী লীগের পতনটাই অর্জন বা এখানেই জুলাই শেষ। আমাদের কাছে জুলাই এখান থেকে শুরু আসলে। সেই জায়গায় আমাদের অবশ্যই অপ্রাপ্তি আছে। কিন্তু এ সংগ্রাম বা আকাক্সক্ষার জন্য যাত্রাটা চলমান। সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম আরো বলেন, আমরা কোনো দলের বিরুদ্ধে বা পক্ষেÑবিষয়টা এমন নয়। আমরা পুরনো বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে। বিএনপি এ বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। তারা শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাইছে। এখন বিএনপি বা যে কোনো দল যদি পুরনো বন্দোবস্তকে রক্ষা করতে চায় বা আওয়ামী লীগের জায়গায় পুনঃস্থাপিত হতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে নতুন আওয়ামী লীগ হিসেবে দেখা হবে। বিএনপি তার রাজনীতি স্পষ্ট করেনি। নতুন রাজনীতির জন্য নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংস্কার প্রয়োজন। জামায়াতের বিরুদ্ধে একাত্তরের গণহত্যা-সম্পর্কিত যে অভিযোগ আছে, তারাও সে বিষয়টি পরিষ্কার করেনি। সে জায়গা থেকে পুরনো রেটোরিক বা পুরনো ধাঁচের রাজনীতি আবার ফেরত আসছে।
নাহিদ ইসলামের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে, কিন্তু ওই ব্যবস্থার পতন বা বিলোপ ঘটেনি। সে ব্যবস্থা এখনো রয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি বা যে কোনো দল যদি পুরনো বন্দোবস্তকে রক্ষা করতে চায় বা আওয়ামী লীগের জায়গায় পুনঃস্থাপিত হতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে নতুন আওয়ামী লীগ হিসেবে দেখা হবে। বিএনপি তার রাজনীতি স্পষ্ট করেনি। নতুন আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম যে বক্তব্য রেখেছেন তার একটা যৌক্তিক ভিত্তি আছে। নাহিদ আরো বলেছেন, নতুন রাজনীতির জন্য নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংস্কার প্রয়োজন। জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন নাহিদ। তিনি বলেছেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে একাত্তরের গণহত্যা সম্পর্কিত যে অভিযাগ আছে, তারাও সে বিষয়টি পরিষ্কার করেনি। সে জায়গা থেকে পুরোনো রেটোরিক বা পুরোনো ধাঁচের রাজনীতি আবার ফেরত আসছে। জামায়াতের বিরুদ্ধে একাত্তরের গণহত্যা সম্পর্কিত যে অভিযোগ, তা একটি গুরুতর অভিযোগ। সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন যে, এ অভিযোগ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ও গণমাধ্যমে যত আলোচনা হয়েছে, আর কোনো বিষয় নিয়ে বোধহয় এতো আলোচনা হয়নি। জামায়াতের স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতারা বার বার এ অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। পত্র-পত্রিকায়, সাক্ষাৎকারে, টকশোতে ওই অভিযোগের এতো জবাবের পরও বিষয়টি কেন পরিষ্কার হলো না তা এক রহস্যময় বিষয় বটে। এতো জবাবের পরতো বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার কথা। তবে কোনো বিষয় পরিষ্কার হওয়া আর মনমতো হওয়া এক বিষয় নয। হয়তো এ কারণেই বিষয়টি এখনো অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়। টেলিভিশনের বিভিন্ন টকশোতেও আমরা বিষয়টি লক্ষ্য করেছি। জামায়াত নেতারা অভিযোগের জবাব দেওয়ার পরও উপস্থাপক খুশি হতে পারছেন না। তিনি এদিক থেকে সেদিক থেকে প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে প্রশ্ন করছেন, লক্ষ্য মনমতো একটা জবাব বের করে আনা। মনমতো জবাব পাওয়ার এ ছিলছিলা যতদিন অব্যাহত থাকবে, ততদিন হয়তো বিষয়টি পরিষ্কার হবে না। আসলে উদ্দেশ্যপ্রবণ হলে কোনো বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। আর আমাদের রাজনীতিতে তো ব্লেমগেম তথা দোষারোপের রাজনীতি প্রবল। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন না হলে একাত্তরের ওই অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া জামায়াতের জন্য কঠিন।
সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম ঠিকই বলেছেন, নতুন রাজনীতির জন্য নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংস্কার প্রয়োজন। জাতীয় নাগরিক পার্টি তথা এনসিপির আহ্বায়ক হিসেবে এ কয় দিনেই হয়তো নাহিদ ইসলাম উপলব্ধি করেছেন নানা বাস্তবতা। ইতিমধ্যেই এনসিপি’র বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও। সব অভিযোগ কি সঠিক? কোনো অভিযোগই সঠিক নয়, তাও বলা যাবে না। নাহিদ ইসলামদের তো আমরা কোনো অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতেও দেখেছি। ফলে বলা যায়, অন্যান্য দলের মত এনসিপিতেও অভ্যন্তরীণ সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এসব কিছুর পরও এই বিষয়টি সবাইকে স্বীকার করে নিতে হবে যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নাহিদ ইমলামসহ তার সাথীরা যে ত্যাগ ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। সময়ের দাবি পূরণে সৈনাপত্যের দায়িত্ব পালনের জন্য বিশেষ সম্মান তাদের প্রাপ্য। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, রাজনীতি এমন এক কঠিন ও জঠিল প্রতিযোগিতার ময়দান, যেখানে কোনো দলের পক্ষেই একেবারে ত্রুটিমুক্ত থাকা সম্ভব নয়। তাই সংস্কার ও সংশোধনের চেতনাকে লালন করেই দলগুলোকে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই ফ্যাসিবাদের বিপদ থেকে দেশ জাতি রক্ষা পেতে পারে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকীতে গণঅভ্যুত্থানের আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে কথা হচ্ছে। কথাগুলো এক রকম নয়। সমালোচনা, আত্মসমালোচনা সবসময়ই ভালো বিষয়। কিন্তু বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সমালোচনা, ফ্যাসিবাদের পাপ মোচনের কথকতা কখনো প্রশ্রয় পেতে পারে না। গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকীতে এসে আমরা যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই, তখন কী দেখবো? ফ্যাসিস্ট সরকার কি দেশটাকে আস্ত রেখে পালিয়ে গিয়েছিল? ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশ। আইন-আদালত, পুলিশ-প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোন কিছুই ঠিক ছিল না। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে তো আমরা কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ পাইনি, তাহলে কেমন করে আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় সে সোনার বাংলা পেয়ে যাবো? আরও গভীর বিষয় হলো, গণঅভ্যুত্থানের পর যে অস্থিরতা দেখা যায়, তা সামাল দেওয়ার কোনো সহজ বিষয় নয়। জনগণের দুর্বার আবেগের দ্রুত বাস্তবায়ন গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী কোনো সরকারের পক্ষে কোনো দেশেই সম্ভব হয়নি। বাস্তব মাটিতে পা রেখেই সব দেশকে এগুতে হয়েছে। একই বাস্তবতা অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্যও।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের চিত্রটা কেমন ছিলো? কেউ চেয়েছিলেন বিপ্লবী সরকার গঠন করে সংবিধান স্থগিত করতে। কেউ চেয়েছেন ড. ইউনূসের সরকারকে সম্ভব হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত করতে। কেউ চেয়েছেন, বাংলাদেশে সব ধরনের সাংবিধানিক ও আইনি সংস্কার করে আমাদের গণতন্ত্রকে চিরস্থায়ী করে তুলবেন। এতো ভাবনা, এত চিন্তায় সবাইতো এক ভাষায় কথা বলেননি। মতপার্থক্য হয়েছে, তর্ক হয়েছে, তারপরও দেশ গণতন্ত্রের পথেই হাঁটছে। ফ্যাসিস্টদের বিচার ও সংস্কার উদ্যোগের পাশাপাশি নির্বাচনের রোডম্যাপও উঁকি দিচ্ছে। এখনো ‘জুলাই ঘোষণা’ না হওয়াটা কিন্তু জাতির জন্য দুঃখজনক। অচিরেই এটি না হলে নতুন সংকট দেখা দিতে পারে। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, সার্বভৌমত্বের চেতনায় গণতান্ত্রিক পথচলায় প্রধান বাধা শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সফল হয়েছে দেশের ছাত্র-জনতা। নৈরাজ্যের বিপদ কাটিয়ে দেশ ক্রমেই শৃংখলা ও সংহতির পথে এগুতে সক্ষম হচ্ছে। দেশে তর্ক আছে, নানা মত আছে, তারপরও আলোচনার পরিবেশ আছে, যা আগে ছিল না। এটাই গণতন্ত্রের পথ, এটাই মুক্তির পথ।