মানবাধিকার কোনো বিলাসিতা নয়; এটি প্রতিটি মানুষের জন্মগত, অবিচ্ছেদ্য ও সর্বজনীন অধিকার। প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘ ঘোষিত ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস’-এর মূল চেতনা স্মরণ ও পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালিত হয়। ২০২৫ সালের বাংলাদেশে এই দিবসটি বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে। কারণ আমাদের সামনে এখনো রয়ে গেছে মানবাধিকারের ন্যূনতম নিশ্চয়তা, আইনের শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও নিরাপত্তা খাতে জবাবদিহি নিশ্চিত করার মতো মৌলিক চ্যালেঞ্জ।

২০২৫ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতির আলোচনায় দুটি প্রশ্ন সর্বাগ্রে উঠে আসে-রাষ্ট্র কি তার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যথেষ্ট? আর নাগরিকেরা কি ভয়শূন্যভাবে তাদের মৌলিক স্বাধীনতা চর্চা করতে পারছেন? ফ্যাসিবাদী শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরের মানবাধিকার লংঘন বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক সহিংসতা, সভা-সমাবেশে বাধা, মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশ্লিষ্ট উদ্বেগ, কারাগার ব্যবস্থার দুরবস্থা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের মতো ইস্যুগুলো বারবার সামনে এসেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এমনকি জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে।

গণতন্ত্র দুর্বল হলে মানবাধিকারও হুমকিতে পড়েÑএটি বিশ্বজনীন সত্য। আগামী ফেব্রুয়ারিতে যেহেতু জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে তাই এবারের মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা, নির্বাচন পদ্ধতির বিশ্বাসযোগ্যতা এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে নাগরিক অংশগ্রহণ-এসবই মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। শুধু নাগরিক অধিকার নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারও মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, বৈষম্য বৃদ্ধি, শ্রম অধিকার লঙ্ঘন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, শিক্ষায় বৈষম্য এবং স্বাস্থ্যসেবায় সীমাবদ্ধতা-এসব সমস্যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন রূপ তৈরি করছে। শ্রমজীবী মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, রোহিঙ্গা শরণার্থী, নদীভাঙন ও জলবায়ু বিপর্যস্ত মানুষের অধিকার রক্ষায় আরও কার্যকর নীতি গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

এর পাশাপাশি, ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমন তথ্যপ্রবাহকে সহজ করেছে, তেমনি নজরদারি, ভুল তথ্য, সাইবার হুমকি ও মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণের নতুন দরজা খুলেছে। ডিজিটাল আইনের প্রয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ, অনলাইন মতপ্রকাশে ভয়-আতঙ্ক এবং সামাজিক মাধ্যমে নজরদারির অভিযোগÑএগুলোও মানবাধিকার পরিস্থিতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। প্রযুক্তি যেন নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষার হাতিয়ার হয়, নিয়ন্ত্রণের নয়-এই নীতি গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। মানবাধিকার রক্ষা কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়; সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এবং সচেতন জনগোষ্ঠীরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনাই যেমন ন্যায়বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন, তেমনি মানবাধিকার বিষয়ে শিক্ষার প্রসার, সহনশীলতার সংস্কৃতি গঠন এবং সামগ্রিকভাবে নৈতিক ও মূল্যবোধনির্ভর সমাজ নির্মাণ অপরিহার্য।

২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস আমাদের সামনে শুধু উদযাপনের বিষয় নয়, বরং আত্মসমালোচনা, পুনর্মূল্যায়ন এবং দৃঢ় সংকল্প গ্রহণের আহ্বান। আমরা কেবল তখনই এগিয়ে যেতে পারব যখন মানবাধিকার হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, আইনের শাসন হবে অবিচল, আর প্রতিটি মানুষ তার মত, চিন্তা, পরিচয় ও মর্যাদার কারণে সম্মান ও সুরক্ষা পাবে।

বাংলাদেশ তার ইতিহাসে সবসময় মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়বিচার ও মানবমর্যাদার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এখন প্রয়োজন সেই অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দেওয়া-যাতে আগামী প্রজন্ম একটি অধিক স্বাধীন, অধিক ন্যায়ভিত্তিক ও অধিক মানবিক বাংলাদেশ পায়।