আন্তর্জাতিক সকল আইন ও কনভেনশনে নারী ও শিশুদের ওপর হামলা বা নির্যাতনের বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য। যুদ্ধক্ষেত্রেও নারী ও শিশুদেরকে ছাড় দেয়ার প্রচলিত ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু জায়নবাদী দখলদার রাষ্ট্র ইসরাইল এসব আইন কানুন ও সভ্য প্রথার কোনো তোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় তাদের নজিরবিহীন বর্বরতা ও গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে। গাজায় গত ১৯ জানুয়ারি থেকে এক ধরনের যুদ্ধবিরতি চলছে। এ যুদ্ধবিরতি চলমান থাকা অবস্থাতেও ইসরাইল নানাভাবে চুক্তি লংঘন করেছে, নিয়মিতভাবে মানুষ হত্যা জারি রেখেছে। তারপরও শান্তি রক্ষার স্বার্থে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীরা সেগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে যুদ্ধবিরতি চলমান রাখার চেষ্টা করে গেছে।

কিন্তু সর্বশেষ গত রাতে ইসরাইলের বর্বরতা সহ্যের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ইসরাইল মাত্র একরাতে বিমান হামলা চালিয়ে ৩শরও বেশি ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে যার অধিকাংশই শিশু। ইসরাইলী এ নৃশংস হামলার মধ্য দিয়ে হামাসের সাথে দু-মাসের নাজুক যুদ্ধবিরতি ভেঙে গেছে-অন্তত এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজাজুড়ে ইসরাইলী হামলায় নিহতদের অনেকেই শিশু। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এ হামলার পরও সামান্য পরিমাণ অনুশোচনা না করে উল্টো দম্ভভরে জানিয়েছেন যে, তিনি নিজেই সেনাবাহিনীকে হামলা করতে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে যুদ্ধবিরতি আলোচনাকে আরো ত্বরান্বিত করা যায়।

কী নির্মম ও ভয়াবহ যুক্তি। অথচ বিশ্বের সকল শান্তিকামী ও সচেতন মানুষ জানেন যে, ইসরাইলের বিশেষ করে দেশটির বর্বর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং তার উগ্রবাদী সহযোগীদের অসহযোগিতার কারণেই যুদ্ধবিরতি চুক্তি বা আলোচনা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। হামাসের প্রতিনিধিরা আলোচনার অগ্রগতির জন্য উদার মন নিয়ে কায়রো ও দোহায় ঘুরে বেড়ালেও ইসরাইল কখনো যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্বে যেতেই আগ্রহী হয়নি। অথচ প্রথম যখন ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি চালু হয়েছিল তখনই এমনও সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, তিনটি পর্যায়ে এই যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু প্রথম পর্বের শেষ দিক থেকেই ইসরাইল গড়িমসি শুরু করে। হামাস চুক্তিমতো তার হাতে থাকা জিম্মিদের ছেড়ে দিলেও এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলীদের বিভিন্ন কারাগার থেকে যে ফিলিস্তিনীদের মুক্তি দেয়ার কথা ছিল, তারা তা দেয়নি। কয়েকদিন সময় নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তারা ফিলিস্তিনী বন্দীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এরপর থেকেই ইসরাইল আর যুদ্ধবিরতি কার্যকরে আগ্রহ দেখায়নি।

গাজার মানুষকে কালেকটিভ পানিশমেন্ট বা সম্মিলিত শাস্তি দেয়ার কৌশল ইসরাইল শুরু করেছে চলতি রমযান মাসের শুরু থেকেই। মাসের শুরুতে, ইসরাইল গাজার সকল সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দেয় এবং হামাসকে নতুন যুদ্ধবিরতির শর্ত মানতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে গাজায় খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। এছাড়া, ইসরাইল গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে, যার ফলে উপত্যকার একমাত্র পানি পরিশোধনাগার কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে এবং ফিলিস্তিনীরা বিশুদ্ধ পানির উৎস থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ সতর্ক করেছে যে গাজার দশ লাখ শিশু মৌলিক প্রয়োজনীয়তা পূরণ হওয়া ছাড়াই বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। কারণ সেখানে মানবিক সংকট আরও তীব্র হচ্ছে, এবং ইসরাইল সব ধরনের সহায়তা অবরুদ্ধ করে রেখেছে।

গাজা উপত্যকায় ১০টি দাতব্য খাদ্য রান্নাঘর এবং অন্যান্য মানবিক সেবা পরিচালনাকারী সংস্থা জানিয়েছে, ইসরাইলের সকল মানবিক সহায়তা অবরোধের পর এখন মাত্র দুটি খাদ্য বিতরণ কেন্দ্র চালু রয়েছে। ইসরাইলী অবরোধ অব্যাহত থাকায় হাজার হাজার মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহকারী দাতব্য সংস্থাগুলো শুধু কমিউনিটি কিচেন নয় বরং সার্বিক কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। যে কয়েকটি এখনো চালু রয়েছে, সেগুলো ধীরে ধীরে কার্যক্রম কমিয়ে আনছে, কারণ রান্নার গ্যাস, পানি এবং অন্যান্য জরুরি সামগ্রী আর পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারগুলোতে পণ্য শেষ হয়ে আসছে, আর যেটুকু আছে, তার দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। যেসব কমিউনিটি রান্নাঘর দিন কয়েক আগেও হাজার হাজার মানুষকে খাওয়াতো, তারাই এখন তীব্র সংকট ও ক্রমবর্ধমান দুর্ভিক্ষের ঝুঁকির মুখে পড়েছেন।

একদিকে খাবারের অভাবে ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে আর অন্যদিকে আকাশপথে বিমান হামলার মাধ্যমে ইসরাইল গাজার মানুষগুলোকে হত্যার যে ভয়াবহ অমানবিক কৌশল অবলম্বন করছে এর বিরুদ্ধে বিশ্ব মানবতার সোচ্চার ও সরব হওয়া জরুরি। আমরা অবিলম্বে ইসরাইলের এই অমানবিক কার্যক্রমের অবসান চাই।