বর্তমান সভ্যতায় আক্রান্ত ও বিধ্বস্ত দেশগুলোর নাম উচ্চারণ করতে গেলে সিরিয়ার নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। বছরের পর বছর দেশটিতে ছড়ি ঘুরিয়েছে সভ্যতার শাসকরা, যাদেরকে আমরা পরাশক্তিই হিসেবে অভিহিত করে থাকি। ভূরাজনীতির ছলনায় রাশিয়া ও আমেরিকা সিরিয়ায় যুদ্ধের মহড়া চালিয়েছে, মারণাস্ত্রের সক্ষমতা পরীক্ষা করেছে। অস্ত্রের মূল্য নিয়ে দর কষাকষি করেছে, বাজার সম্প্রসারণ করেছে। এমন নিষ্ঠুর বিশ^ব্যবস্থায় সিরিয়া ধ্বংস হয়েছে, মানুষ নিহত হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে পশুপালের মত দলে দলে মানুষ সমদ্রমুখী হয়েছে। উদ্দেশ্য অভিবাসী হবেন। সমুদ্র তো তার স্বভাবেই উত্তাল। সমুদ্র পাড়ি দেওয়াতো সহজ কর্ম নয়। ফলে সলিলসমাধি হয়েছে বহু সিরীয় নারী-শিশু ও বৃদ্ধের। সে এক নির্মম ও করুণ দৃশ্য। শিশু আয়লানের কথা মনে পড়ে কী? সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে ডুবন্ত শিশু কতটা লড়তে পারে? ছোট্ট মানবকুঁড়ি হিম হতে হতে নিথর হয়ে যায়। সাগর অবশেষে করুণা করে সৈকতে রেখে যায় দুর্ভাগা আয়লানের নিষ্প্রাণ দেহ। এতো আমাদের সভ্যতার উপহার। এতো সিরিয়ার স্বৈরশাসক আসাদের আমলনামা। স্বৈরশাসকেরা পরাক্তির আজ্ঞাবহ হয়, জননন্দিত রাষ্টনায়ক হতে পারে না। এটাইতো পৃথিবীর ইতিহাস।
ধ্বংসের মোহনা থেকে সিরিয়া এবার নতুন এক অভিযাত্রা শুরু করতে চাইছে। এ অভিযাত্রায় দেশটির অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি নতুন জাতীয় প্রতীক হিসেবে ‘সোনালি ঈগল’ উন্মোচন করেছে। এ প্রতীক শুধু একটি চিত্র নয়, বরং এটি বাশার আল-আসাদ সরকারের স্বৈরশাসন থেকে বেরিয়ে এসে একটি নতুন গণতান্ত্রিক এবং স্বাধীন সিরিয়ার গভীর আকাক্সক্ষা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরছে। এ সোনালি ঈগলের পেছনে লুকিয়ে আছে কোন্ বার্তা, আর কেনই বা এটি সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নির্দেশনার প্রতীক হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে চলছে ব্যাপক আলোচনা। বার্তাসংস্থা সানা জানায়, সোনালী ঈগল বহু শতাব্দী ধরে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি, শক্তি এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ প্রতীকের মাথায় রয়েছে তিনটি তারা, যা সিরিয়ার জনগণের মুক্তিকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরেছে। ঈগলের লেজের পাঁচটি পালক দেশটির পাঁচটি ভৌগলিক অঞ্চলÑউত্তর, পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ ও কেন্দ্রকে নির্দেশ করে। আর ডানার ১৪টি পালক প্রতিটি প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। সরকারের ভাষ্য মোতাবেক, এই ১৪টি পালকের প্রতিটিই প্রতিরোধের গল্প বহন করে। সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সানা জানিয়েছে, নতুন জাতীয় পরিচয় চালুর ফলে শিগগিরই জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টসহ সরকারি কাগজপত্রে সোনালী ঈগলের এই নকশা যুক্ত করা হবে।
জাতীয় প্রতীক ‘সোনালী ঈগল’ উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা বলেন, ‘আজ আমরা যে পরিচয় চালু করছি তা আমাদের ঐক্য, অবিভাজ্য এবং নতুন ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। সোনালি ঈগল আমাদের শক্তি, দৃঢ়তা, গতি ও উদ্ভাবনের প্রতীক।’ তিনি আরও বলেন, ‘দামেস্কের ইতিহাস বিশ^ইতিহাসের সূচনা ও শেষের গল্প। আমরা যে অপমানজনক সময় পার করেছি, সেটি দামেস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়। সে অধ্যায় শেষ হয়েছে। আমাদের পতনের সময় পেরিয়ে গেছে, শুরু হয়েছে পুনর্জাগরণের সময়।’ সিরিয়া নতুন জাতীয় প্রতীক হিসেবে ‘সোনালি ঈগল’ উন্মোচন করেছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা বলেছেন, আমরা অপমানজনক সময় পার করেছি, এখন শুরু হয়েছে পুনর্জাগরণের সময়। সিরিয়ার পুনর্জাগরণের এ আকাক্সক্ষাকে আমরা সম্মান করি। প্রতিটি জাতিরই আপন আদর্শে বিকশিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। ভুল বিশ^ব্যবস্থায়, আগ্রাসী ভূরাজনীতির শিকার হয়েছে বহু দেশ। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া-এর বড় উদাহরণ। সিরিয়া এখন পুনর্জাগরণের কথা বলছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনো মানুষ সিরয়ার এই আকাক্সক্ষাকে সমর্থন করবে। কারণ পৃথিবীটাতো বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা বর্ণের মানুষের পৈত্রীক সম্পত্তি নয়। আর মারণাস্ত্রের ভয় দেখিয়েও পৃথিবীটাকে শাসক করা যাবে না। আফগানিস্তান, ইরান ইতিমধ্যে সেই উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। মুসলিম উম্মাহ’র সদস্য হিসেবে আমরাও সিরিয়ার পুনর্জাগরণের আকাক্সক্ষাকে জানাই অভিনন্দন।