২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধারা “অপারেশন আল আকসা ফ্লাড” নামে যে অভিযান শুরু করেছিল, তার দুবছর পূর্ণ হয়েছে। এ অভিযানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দখল, হত্যা ও অবরোধের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের ন্যায্য প্রতিরোধের অধিকার ঘোষণা করেছিল। এটি শুধু একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং দখলদার ইসরাইলের অবিচারের বিরুদ্ধে এক জাতির আত্মমর্যাদা রক্ষার প্রতীক। এ অভিযান কেবল একদিনের সামরিক ঘটনা ছিল না, বরং এটি ছিল দখলদার ইসরাইলের অবিচারের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনগণের শতবর্ষের ক্ষোভ ও প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ।
দুবছর পার হয়ে গেছেÑ কিন্তু গাজার মাটিতে এখনো রক্তের দাগ শুকায়নি। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রায় ৬৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। হাজার হাজার পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সংবাদমাধ্যমের কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গাজা এখন কার্যত একটি ধ্বংসস্তূপÑএকটি উন্মুক্ত কারাগার, যেখানে বেঁচে থাকাই এক প্রতিদিনের সংগ্রাম। খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও ওষুধের সংকটে কোটি মানুষের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অথচ, তথাকথিত সভ্য বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অধিকাংশ সময়েই নীরব দর্শকের ভূমিকায় থেকেছে।
এ ভয়াবহতার মাঝেও ফিলিস্তিনিরা হার মানেনি। তাদের প্রতিরোধ এখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, ইস্তাম্বুল, কায়রো, জাকার্তা থেকে ঢাকা পর্যন্ত লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে এক কণ্ঠে বলছেÑ “দখলদারিত্ব নিপাত যাক, ফিলিস্তিন মুক্তি পাক।” বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, সংসদ ভবনে, আন্তর্জাতিক সম্মেলনেÑ ফিলিস্তিন আজ মানবতার এক অগ্নিপরীক্ষার নাম। এ দুবছরে কূটনৈতিক অঙ্গনেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের হিসাবে, ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের ১৫৭টি সদস্যরাষ্ট্র স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ সংখ্যাটি সমস্ত ইউএন সদস্য দেশের প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি। নতুন-নতুন আরও কিছু পশ্চিমা দেশ ২০২৫-এ স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যেমন ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি। এর মধ্যে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতা থাকায় আগামীতে জাতিসংঘের যে কোনো প্রস্তাবনায় ফিলিস্তিন সুবিধা পাবে বলে আশা করা যায়।
এমন প্রেক্ষাপটে ইসরাইলের অবস্থান ক্রমেই নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ১৯৪৮ সালে যে রাষ্ট্রটি “নিরাপদ আবাসের” নামে স্থাপিত হয়েছিল, আজ সেটি বিশ্ব বিবেকের সামনে পরিণত হয়েছে একটি বর্ণবাদী ও দখলদার শক্তিতে। “দুই রাষ্ট্র সমাধান”-এর কথা আন্তর্জাতিক মহল বহু বছর ধরে বললেও ইসরাইলের বসতি স্থাপন, ভূমি দখল ও গাজা অবরোধের নীতিতে স্পষ্টÑ তারা ফিলিস্তিনের অস্তিত্বই স্বীকার করতে চায় না। শান্তির ছদ্মবেশে তারা বাস্তবে চালিয়ে যাচ্ছে জাতিগত নিধন ও গণঅবরোধ।
অতএব, এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় অবস্থান। শুধু উদ্বেগ প্রকাশ বা মানবিক সহায়তার আহ্বান যথেষ্ট নয়। ইসরাইলের প্রতি সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করতে হবে, জাতিসংঘকে অবশ্যই বাধ্যতামূলক প্রস্তাবের মাধ্যমে গাজার ওপর অবরোধ তুলে নেওয়ার দাবি জানাতে হবে। মুসলিম বিশ্বকেও নিজেদের সীমিত প্রতিক্রিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত শিশুদের মুখের দিকে তাকালে যে কোনো মুসলমানের হৃদয় কাঁপবে, কিন্তু সে আবেগকে এখন রূপ দিতে হবে কার্যকর রাজনৈতিক উদ্যোগে।
বাংলাদেশের অবস্থান সবসময়ই ছিল ফিলিস্তিনের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি সরকারই ফিলিস্তিনের প্রতি আকুন্ঠ সমর্থন প্রদান করেছে। এখন সময় এসেছে এ অবস্থানকে আরও উচ্চকণ্ঠে বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরার। বাংলাদেশের উচিত, মুসলিম ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে জাতিসংঘে একটি শক্তিশালী প্রস্তাব উত্থাপন করা, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবেÑ দখলদারিত্ব মানবতার পরিপন্থী এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাই মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির একমাত্র ভিত্তি।
অবশেষে, আমাদের মনে রাখতে হবেÑ ফিলিস্তিনের মুক্তি শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, এটি সমগ্র মানবজাতির মর্যাদা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। কারণ, যদি বিশ্ব অন্যায়ের সামনে নীরব থাকে, তবে সে অন্যায় একদিন সবার দোরগোড়ায় পৌঁছাবে। আল আকসা মসজিদের মেহরাব থেকে যে আহ্বান উঠেছে, তা কেবল একটি জাতির নয়Ñএটি সমগ্র মানবতাকে টিকিয়ে রাখার ডাক। দুই বছর পেরিয়ে আজও গাজার আকাশে ধোঁয়া, কান্না ও রক্তের গন্ধ। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষীÑ কোনো দখলদার শক্তি কখনো স্থায়ী হয়নি। একদিন এ ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকেই জন্ম নেবে স্বাধীন ফিলিস্তিন, যেখানে শিশুরা আবার খেলবে, মানুষ আবার হাসবে, আর আল কুদসের মাটিতে প্রতিধ্বনিত হবেÑ “দখলদারিত্ব নিপাত যাক, ফিলিস্তিন মুক্তি পাক।