মহান আল্লাহ তায়ালা মানব-বান্ধব করে পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আমরা না হতে পারলাম পৃথিবীর বান্ধব, না মানবের বান্ধব। আল্লাহ তো কাশ্মীরকে সৃষ্টি করেছেন স্বর্গের মতো করে। কিন্তু কাশ্মীরবাসীর বসবাস আজ কেন নরকে? স্বর্গকে নরকে পরিণত করলো কারা? ভারতে কেন আজ তাদের ওপর নির্যাতন? ২৮ এপ্রিল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের পাঞ্জাবের সরু ও জনাকীর্ণ গলি দিয়ে ২২ এপ্রিল হাঁটছিলেন কাশ্মীরি আসিফ দার। হঠাৎ তিনি উপলব্ধি করলেন, চারপাশের সবাই তাকে খেয়াল করছেন। তবে তাদের দৃষ্টিতে বন্ধুত্বের কোনো চিহ্ন ছিল না। দার বললেন, প্রতিটি চোখই যেন প্রতিহিংসা নিয়ে আমাকে দেখছে। পরদিন সকালে আসিফ দুধ কিনতে বাজারে যান। তাকে দেখেই তিনজন লোক মুসলিমবিদ্বেষী গালি দেওয়া শুরু করে। একজন চিৎকার করে বলে, ‘ও কাশ্মীরি, ওদের জন্যই সবকিছু হয়েছে।’ উল্লেখ্য, ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের লক্ষ্য করে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা হামলা চালায়। হামলায় ২৬ জন নিহত ও বহু লোক আহত হন। হামলার জন্য ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। এ হামলার ঘটনায় অবশ্য একইসঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ও জাতিগত দ্বন্দ্বের বিষয়টি আবার প্রকাশ্যে এলো। পাকিস্তান অবশ্য ভারতের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

এদিকে কাশ্মীরের গভীর বন ও পাহাড়ে কথিত হামলাকারীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী। বর্তমান সময়ে ভারতজুড়ে থাকা কাশ্মীরিরা, বিশেষ করে কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা নানাভাবে আক্রমণ, হয়রানি ও হুমকির শিকার হচ্ছেন। তাদের সহপাঠীরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশে কাশ্মীরি ভাড়াটেদের বের করে দিচ্ছেন বাড়ির মালিকরা। দোকানদাররা কেনাবেচা করতে অস্বীকার করছেন তাদের সাথে। অসহায় কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে বাড়ি ফিরছেন। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে বিমান বন্দরে ঘুমাতে হচ্ছে কাশ্মীরিদের। আসিফ বলেন, অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হামলার জন্য এখন কাশ্মীরিদের মূল্য দিতে হচ্ছে। পাঞ্জাবের জলন্ধরে অ্যানেসথেসিয়া অ্যান্ড অপারেশন থিয়েটার টেকনোলজির দ্বিতীয় সেমিন্টারের শিক্ষার্থী আসিফ দার। বাবা-মাকে ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য এটিই তার প্রথম কাশ্মীরের বাইরে আসা। তিনি বলেন, কাশ্মীরে উচ্চ শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য আমি নিজেকে তৈরি করতে চাই। আমি যদি ভালো করতে পারি, তাহলে পরিবারকে সহায়তা করতে পারবো। কিন্তু বাস্তবতা তার জন্য বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আর ক’দিন পরই তার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। এরমধ্যেই পেহেলগামের ঘটনায় উদ্বিগ্ন ও বিষণ্ন হয়ে পড়েছে আসিফ দার। আসিফ বলেন, গত ক’মাসে আমি যা পড়েছি, তার সবকিছু ভুলে গেছি। অব্যাহত এ অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি ক্লাস করবো, না বাড়ি ফিরে যাব কিছুই বুঝতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, যেদিকে তাকাই, সেদিকেই অবিশ্বাস দেখি। আমরা অভিশপ্ত। যেখানেই যাই, আমাদের চেহারা আমাদের পরিচয় প্রকাশ করে দেয়।’ আসিফ বলেন, পেহেলগামে নিহত ২৬ জনের মধ্যে ২৫ জনই হিন্দু। এর জেরে ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাশ্মীরবিরোধী ও মুসলিমবিরোধী প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে। তবে এসব প্রচারণায় এড়িয়ে যাওয়া হয় হামলায় নিহত ২৬তম ব্যক্তির পরিচয়। নিহত ওই ব্যক্তি একজন কাশ্মীরি মুসলমান, যিনি পর্যটকদের রক্ষার জন্য হামলাকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

কাশ্মীরে বসবাসকারী রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখ শওকত বলেন, ‘আজকের ভারত বিপুলভাবে জাতিগত হিংসামূলক প্রোপাগান্ডায় ভর করে চলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে এ প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। এ বিবেচনায় কাশ্মীরিরা সহজ লক্ষ্যবস্তু। একদিকে কাশ্মীরি, অন্যদিকে মুসলমান হওয়ার কারণে দু’দিক থেকেই তারা প্রোপাগান্ডার শিকার হচ্ছে। শওকত সাহেবের বিশ্লেষণে জাতিগত হিংসামূলক প্রোপাগান্ডার কথা উঠে এসেছে। এমন প্রোপাগান্ডা কোনো দেশের জন্য কল্যাণকর বলে বিবেচিত হতে পারে না। আজ কাশ্মীরিরা জুলুমের শিকার হচ্ছে, কাল হয়তো অন্য কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের লোক মজলুম হবেন। এভাবে মজলুমের সংখ্যা বাড়তে থাকলে ভারতে ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ কিভাবে রক্ষিত হবে? রাষ্ট্রের দর্শন ভঙ্গ করা হলে, রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষিত হবে কেমন করে? বিষয়টি গভীর বিবেচনার দাবি রাখে।