যে কোনো দেশেই সেনাবাহিনী থাকে, থাকে আধা-সমরিক বাহিনীও। তাদের কর্তব্যও সুনির্দিষ্ট। তবে দেশের নাগরিকদের হত্যা তাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। যদি এমন হয়-তারা গণহত্যা চালালেন এবং স্বজনরা যখন তাদের জানাযা পড়তে এলেন, তখন তাদের ওপরও চালানো হলো ড্রোন হামলা, এতে নিহত হলেন নর-নারী ও শিশু; এমন বাহিনীকে কোন নামে অভিহিত করা সঙ্গত হবে? না আমি কোনো রহস্য কাহিনীর কথা বলছিল না, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের কথা বলছি। ঘটনাগুলো ঘটছে সুদানে। ৪ নবেম্বর প্রকাশিত এএফপি ও আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, সুদানে দু’বছরের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ। জানাযায় ড্রোন হামলার ঘটনাটি ঘটেছে সুদানের মধ্যাঞ্চলে। আধা-সামরিক বাহিনী র্যপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর এ হামলায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪০ জন।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের এপ্রিলে সুদানের সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনী আরএসএফ-এর মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে সংঘাত শুরুর পর থেকে দেশজুড়ে চলছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সম্প্রতি সুদানের দারফুর অঞ্চলের এল ফাশার শহরে ভয়াবহ গণহত্যার চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক মহল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রতিবাদের মাধ্যমেই কি তারা তাদের কর্তব্য সমাপ্ত করবেন? নাকি গুরুত্বপূণ আরো কিছু করণীয় রয়েছে? সুদান আজ যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখে পড়েছে, তার দায় শুধু দু’বাহিনীর ঘাড়ে চাপালে হবে না। ২০১৯ সালের বিপ্লব এবং প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির ক্ষতাচ্যুত হওয়ার বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে। আর সুদানে গৃহযুুদ্ধের যে ভয়াবহ রূপ, তাতে ইন্ধন দিচ্ছে কারা? আরএসএফ এত অস্ত্র ও অর্থ পাচ্ছে কেমন করে, কারা-এর যোগানদাতা? ভূরাজনীতির বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সুদানে রক্তপাত বন্ধের জন্য মুসলিম বিশ্বকে সঙ্গত দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান। সোমবার ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি)-এর অর্থনৈতিক সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের উদ্দেশে প্রদত্ত বক্তব্যে তিনি ওই আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘কারো হৃদয়ে সহমর্মিতা থাকলে, সম্প্রতি এল-ফাশেরে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছে তা মেনে নিতে পারে না, আমরা নীরব থাকতে পারি না।’
এরদোগান আরও বলেন, সুদানে রক্তপাত দ্রুত বন্ধ করার বড় দায়িত্ব নিঃসন্দেহে মুসলিম বিশ্বের ওপর বর্তায়। মুসলিম হিসেবে আমাদের অন্যের কাছে সাহায্য না চেয়ে, নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেদেরই করতে হবে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন, এ কঠিন সময়ে সুদানের জনগণের পাশে থাকা এবং মানবিক সহায়তা ও উন্নয়ন-সমর্থন অব্যাহত রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুদানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা আমাদের রক্ষা করতে হবে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট মুসলিম হিসেবে মুসলিম রাষ্ট্র সুদানের জনগণের পাশে দাঁড়াবার কথা বলেছেন, দেশটির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সাহায্যের হাত প্রশস্ত করারও আহ্বান জানিয়েছেন। এখন দেখার বিষয় হলো, তার আহ্বানে ওআইসি’র সদস্য রাষ্ট্রগুলো কতটা সাড়া দেয়। এখানে বলার মত বিষয় হলো, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা ও ভূরাজনীতির বাস্তবতায় কারোই ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নেই। সময়ের আহ্বানে ওআইসিকে জাগতে হবে এবং প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে। ঘুমিয়ে থাকার তো একটা সীমা আছে। সীমালংঘন করলে হয়তো আর কখনো জেগে ওঠার সুযোগই পাবে না ওআইসি।
সুদানের জন্য অর্থবহ কিছু করতে হলে সুদান-সংকটের মূল বিষয়গুলো আমাদের জানতে হবে। প্রথমেই আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০১৯ সালে। এ বছর এক জনপ্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন তদানিন্তন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির। এরপর সুদানের সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনী (আরএসএফ) বেসামরিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে এক ‘অস্বস্তিকর জোট সরকার’ গঠন করেছিল। বিপ্লব করে বশির সরকারকে হটানো গেলেও, দেশগড়ার কাজ ততটা সহজ নয়। দুর্নীতি দূর করে সুশাসনের মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ আরও কঠিন কাজ। এ কাজে প্রয়োজনীয় ধৈর্য, যোগ্যতা এবং ত্যাগ-তিতীক্ষা। এ সবের অভাবে অচিরেই দ্বন্দ্ব দেখা গেল সামরিকদের সাথে বেসামরিকদের। সরকার থেকে বিদায় নিতে হলো বেসামরিকদের। এরপর দেশের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল সুদানের সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনী আরএসএফ । অথচ এ দু’পক্ষ আগে একসঙ্গে সরকারে অংশীদার ছিল। এখন একে অপরকে নির্মূল করার জন্য চালিয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুর লড়াই। এর শিকার হচ্ছে সাধারণ জনগণ। সুদানে মিলিশিয়া বাহিনী আরএসএফ গঠনের ইতিহাস আছে। প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির নিজেকে রক্ষা ও তাঁর হয়ে লড়াই করার জন্য মূলত ‘জানজাউইদ যোদ্ধাদের’ নিয়ে এই বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। প্রেসিডেন্টের সহযোগিতায় আরএসএফ বাহিনীর গোপনে অস্ত্র ও সম্পদে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তবে প্রেসিডেন্ট বশিরের দুঃসময়ে তাঁর সঙ্গ দেয়নি আরএসএফ । ক্ষমতার দিকেই দৃষ্টি ছিল আরএসএফ নেতাদের। এখনো সে পথেই আছেন তাঁরা।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে দু’বাহিনীর মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেটা সেনাবাহিনীর সাথে ছোটখাটো কোনো বিদ্রোহী বাহিনীর সংঘর্ষ ছিল না। আসলে এটি ছিল পূর্ণাঙ্গ দুই সেনাবাহিনীর যুদ্ধ। উভয় পক্ষের কাছেই ছিল অস্ত্রভাণ্ডার, অর্থের উৎস, হাজার হাজার সেনা এবং বিদেশি জোগানদাতা। ফলে উভয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে সুদানে কয়েক কোটি মানুষ ভিটে ছাড়া হয়েছে। নিহত হয়েছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ। সেখানে এখন তিন কোটিরও অধিক মানুষের জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। এসব চিত্রের চাইতেও সুদানের মানুষের দুর্দশার প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো যখন-তখন যেখানে-যেখানে হামলা চালাচ্ছে। দু’বাহিনী সুদানকে আসলে কী উপহারদিল? প্রকাশ্যে আসা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় মানুষ আরএসএফ সেনাদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইছেন। তখন কমান্ডার বলছেন, ‘কেউ বাঁচাবে না।’ এরপর তাকে গুলি করা হয়। কমান্ডার আরো বলেন, ‘আমি তোমাদের প্রতি কোনো দয়া দেখাবো না। আমাদের কাজ শুধুই হত্যা করা।’ সুদানের দারফুর অঞ্চলের আলফাশের শহর আরএসএফ অনেক দিন ঘেরাও করে রেখেছিল। গত সপ্তাহে এই বাহিনী শহরটিতে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়। তারপর হত্যা ও ধ্বংসের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাকে এক কথায় মহাবিপর্যয় বলা যায়।
আরএসএফ এত নৃশংস কেন? বিশ্লেষকরা বলছেন, আজকের আরএসএফ আসলে পুরনো সে ‘জানজাওয়িদের’ নতুন রূপ। এখন তারা উট বা ঘোড়ায় চড়ে আসে না। তারা আসে টেকনিক্যাল গাড়িতে। সে গাড়িতে মেশিনগান বসানো থাকে। তাদের সঙ্গে আরও থাকে ভয়ংকর শক্তিশালী ড্রোন। আরএসএফ এখন আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং বিদেশী মিত্রদের সমর্থনপুষ্ট। ‘অনারব জনগোষ্ঠীকে’ নির্মূল করার অভিপ্রায় নিয়ে যেন তারা এগুতে চাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দারফুর ও আল ফাশের অঞ্চলে যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলছে, তার পেছনে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) বড় ভূমিকা রাখছে। ইউএই বহুদিন ধরেই আরএসএফ-এর ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইউএই এর আগে আরএসএফ মিলিশিয়াদের ভাড়াটিয়া যোদ্ধা হিসেবে ইয়েমেন যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। এখন তারা আরএসএফ-এর হাতে প্রচুর অর্থ ও অস্ত্র দিচ্ছে। এর ফলে সুদানের গৃহযুদ্ধ আরো ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। তবে দারফুর তথা সুদানে নিজেদের ভূমিকা অস্বীকার করে যাচ্ছে ইউএই।
এদিকে সুদানের মতো বড়, কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশটিতে ইউএই নিজেদের প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে। আরএসএফ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর খনি থেকে উত্তলিত স্বর্ণের বেশিরভাগ অংশই পাচ্ছে ইউএই। এছাড়া আরও কিছু দেশ ও গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে জড়িয়েছে সুদানের গৃহযুদ্ধে। ফলে সুদানের গৃহযুদ্ধ এক ধরনের প্রক্সিযুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
বিদেশিরা স্থিতিশীল সুদান চায় না। তাদের স্বার্থে প্রয়োজন এক অস্থিতিশীল সুদান, গৃহযুদ্ধের সুদানÑ যা সুদানের জনগণের জন্য মহাবিপদজনক। সে চিত্র তো ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সুদানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে কথা বলেছেন, গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। কাজটি সহজ নয়। তবে মুসলিম বিশ্ব কার্যকরভাবে এগিয়ে আসলে কাজটি সহজ হয়ে উঠতে পারে।