বাংলাদেশের ইতিহাসে জুলাই মাস এখন আর নিছক একটি ক্যালেন্ডারের অংশ নয়; বরং মাসটি হয়ে গেছে গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা, বৈষম্যবিরোধী চেতনা এবং রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের একটি প্রতীক। জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের রক্তাক্ত প্রেক্ষাপটে জাতির সামনে একটি নতুন রাষ্ট্রচিন্তার বাস্তব ভিত্তি রচিত হয়েছে। এ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় “জুলাই ঘোষণাপত্র” এবং “জুলাই সনদ” দু’টি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দলিল হিসেবে সামনে এসেছে, যা কেবল রাজনৈতিক আকাক্সক্ষাই নয়, বরং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর নির্ধারকও হয়ে উঠতে পারে।
জুলাই ঘোষণাপত্রের কথা প্রথম আমরা শুনেছিলাম ছাত্র অভ্যুত্থানের পটভূমি, শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগ এবং নেতৃত্বের অবদানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়ায়। এটি একধরনের জাতীয় দলিল, যার মধ্যে থাকবে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার জন্য দেশের তরুণ সমাজের সংগ্রামের স্বীকৃতি এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও নীতির সংজ্ঞায়ন। একসময় ঘোষণাপত্রটি শুধুমাত্র ছাত্রনেতৃত্বের পক্ষ থেকে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হলেও, পরবর্তীতে একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে সরকারিভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সম্মিলিত দলিল প্রকাশের কথা ওঠে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দলের কাছে খসড়া চাওয়া হয় এবং আন্দোলনের পক্ষ থেকেও প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিলÑসব প্রস্তাব একত্র করে একটি সর্বজনীন ও সমন্বিত ঘোষণাপত্র তৈরি করা, যা জাতীয়ভাবে ঘোষণা ও উদযাপনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনো এ ঘোষণাপত্রটি দেয়া যায়নি এবং এ অপারগতার নেপথ্য কারণও স্পষ্ট করা হয়নি। গতকাল থেকে জুলাই মাস শুরু হয়েছে। অভ্যুত্থান উপলক্ষে সরকার নানা ধরনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। কিন্তু ঘোষণাপত্র ছাড়া এসব কর্মসূচি কতটা যৌক্তিক- সেই প্রশ্ন আবার নতুন করে সামনে এসেছে। জুলাই ঘোষণাপত্রের পাশাপাশি “জুলাই সনদ” একটি সুগঠিত ও কাঠামোবদ্ধ রাজনৈতিক দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। এ সনদে থাকবে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের রূপরেখাÑযে সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন না হলে জনগণের আকাক্সিক্ষত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
জুলাই সনদ হবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের দলিল, যেখানে সব অংশগ্রহণকারী দল সংবিধানের কোন কোন অনুচ্ছেদ সংস্কারযোগ্য, কোথায় মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজনÑতা নিয়ে স্বাক্ষর করবে। বাস্তবায়নের পথ হতে পারে গণভোট, গণপরিষদ কিংবা সংসদের মাধ্যমে সংশোধনী। গুরুত্বপূর্ণ হলো, সনদে এমন একটি কাঠামো থাকবে, যা পরবর্তী যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, এ সংস্কারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা বাধ্যতামূলক হবে। এভাবে জুলাই সনদ জাতীয় পুনর্গঠনের রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি জাতিকে অনিশ্চয়তা ও বিভক্তি থেকে তুলে আনবে একটি কাক্সিক্ষত ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে। ঐকমত্য কমিশন অবশ্য সম্ভাব্য সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ আলোচনা করছে। তবে প্রতিদিনই যেসব ব্রিফিং আমরা জানতে পারছি তাতে জনগণের প্রত্যাশিত সংস্কারের বাস্তবায়ন নিয়েও শংকা দেখা দিয়েছে।
যারা জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের নেপথ্যে ছিলেন তারা শুরু থেকেই এরকম একটি ঘোষণাপত্র এবং সনদের কথা বলেছিলেন। কারণ তাদের আশংকা ছিল, ঘোষণাপত্র দিয়ে বিষয়টি সংবিধানে না নিয়ে আসলে ইতিহাসের এ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং এত এত শহীদের আত্মত্যাগের বিষয়টি আড়ালে চলে যেতে পারে কিংবা ভবিষ্যতে এগুলোর অপব্যাখ্যা করা হতে পারে। তাছাড়া ঠিক কোন উদ্দেশ্যে গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল এবং এরই চূড়ান্ত পরিণতিতে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছিল সে ব্যাপারগুলো সবার কাছে যেমন স্পষ্ট হওয়া দরকার তেমনি ইতিহাসেও লিপিবদ্ধ থাকা প্রয়োজন।
আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকের মধ্যেই কাক্সিক্ষত সংস্কার নিয়ে দ্বিধা দেখতে পাচ্ছি এবং বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এ জন্য জুলাইর ঘোষণাপত্রের অনুপস্থিতিকে দায়ী করেছেন। এক্ষেত্রে আমরা মনে করি, জুলাই বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে সরকার ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সামনে যে ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগানো জরুরি। আর তা নিশ্চিত করার জন্য জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই। জুলাই মাস শুরু হয়েছে, সামনের মাসে বিপ্লবের এক বছর পূর্তি হবে। অভ্যুত্থানের প্রতি দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবেই অনতিবিলম্বে এই ঘোষণাপত্র ও সনদ প্রণয়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।