॥ প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী ॥

মানুষ আল্লাহর গোলাম। গোলামী করার নিয়ম-কানুন শেখানোর জন্যই নবী প্রেরণ এবং মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-কে শর্তহীনভাবে অনুসরণ করা ঈমানের অপরিহার্য শর্ত। রসুলুল্লাহ (সা.) উপস্থাপিত দীন পরিপূর্ণভাবে মানতে হবে। আল্লাহপাকের নির্দেশ, ‘তোমরা পরিপূর্ণ ইসলামে দাখিল হও, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না’- সুরা বাকারা ২০৮। আল্লাহপাকের দেয়া নিয়ম যতটুকু অমান্য করা হয় ততটুকু শয়তানকে অনুসরণ করা হয়। আল্লাহকে মানার পাশাপাশি তাগুতকেও মানা মূলত আল্লাহর সঙ্গে শিরক ও কুফরি। আল্লাহর বাণী, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো’- সুরা আন নহল ৩৬। সমাজে দীন পরিপূর্ণভাবে মানার ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে রয়েছে নানা মত। মানুষের জীবনকে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক নানাভাবে বিভক্তি টেনে এনে এমন অনেক পরহেজগার মানুষ পাওয়া যায় যাদের সামাজিক, রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক জীবন বড়ো কদর্যপূর্ণ। ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বাইরে অধিকাংশ মানুষ দীনকে খ--বিখ- করে ফেলেছে। তাদের সম্পর্কেই আল্লাহপাকের সাবধান বাণী, ‘তোমরা কি দীনের কিছু অংশ মানবে এবং কিছু অংশ অমান্য করবে, তাহলে দুনিয়ার জীবনে রয়েছে জিল্লতি ও আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ আজাব’- সুরা বাকারা ৮৫। হ্যাঁ, আজকে বিশ^ব্যাপী মুসলমানরা জিল্লতির জীবনই যাপন করছে। আখেরাতে যে ভালো কিছু হবে না আল্লাহ তায়ালা তাও স্পষ্ট করে অগ্রিম জানিয়ে দিয়েছেন।

আল্লাহপাক আমাদের সতর্ক করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো ভয় করার মতো এবং মুসলমান থাকা অবস্থায় ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়’- আলে ইমরান ১০২। ঈমানদার ব্যক্তি মাত্রই আল্লাহকে ভয় করে কিন্তু সে ভয় করার মাত্রা কতটুকু। সন্তান তার বাবা-মাকে ভয় করে, অফিসের কর্মচারী তার বসকে ভয় করে এবং বস তার মালিককে ভয় করে, মানুষ র‌্যাব, পুলিশ, মহল্লার মাস্তানকে ভয় করে- এ ভয় কেন করে? এককথায় জবাব হলো তাদের কিছু ক্ষমতা রয়েছে এবং ভয় করে না চললে ক্ষতির আশঙ্কা করে। এখন আল্লাহপাকের ক্ষমতা এখতিয়ার উপলব্ধি করে কোন্ মাত্রায় তাঁকে ভয় করতে হবে সেটা উপলব্ধি করা দরকার। পিতা-মাতা, অফিসের বস, পাড়ার মাস্তান দুনিয়ার জীবনে ভয় দেখাতে পারে বা ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু আল্লাহপাকের ক্ষমতা-এখতিয়ার পরিমাপযোগ্য নয়। কেউ ক্ষতি করতে চাইলে সেটি তখনই সম্ভব যদি আল্লাহপাক চান। মান-ইজ্জত-সম্মান, সুস্থতা, রিজিক, জীবন সবই আল্লাহপাকের মর্জির উপর নির্ভর করে, সর্বোপরি মৃত্যুর পরে জান্নাত অথবা জাহান্নাম সেটিও নির্ভর করে আল্লাহপাকের ইচ্ছার উপর। সর্বময় ক্ষমতা (সার্বভৌম ক্ষমতা) মূলত আল্লাহপাকের এবং মুসলমান কেবল আল্লাহকেই ভয় করবে।

‘মুসলমান থাকা অবস্থায় ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়’- এ বাক্যে বোঝা যায় জীবনে একবার ঈমান এনে মুসলমান হওয়া বা মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করে ইসলামের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করি বা না করি ইসলাম সর্বদা আমাদের সাথে লেগে থাকবে বিষয়টি এমন নয়। একজন চাকর যেমন সদা-সর্বদা সতর্ক জীবনযাপন করে যাতে তার মনিব অসন্তুষ্ট না হয় তেমনি একজন মুসলমান মহান আল্লাহপাকের সকল বিধি-বিধানের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে যাতে তার কোনো আচরণে আল্লাহপাক সামান্যতম অসন্তুষ্ট না হন। একজন অনুগত চাকরের একদিনের আচরণ বা মনিবকে অমান্য করার পরিণতি পেছনের সকল ভালো আচরণ মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে আল্লাহপাক পরস্পরের বন্ধু বলে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তারপরও পারিবারিক শৃঙ্খলা বিধানের জন্য স্বামীকে কর্তৃত্বশীল করেছেন। স্বামীকে স্ত্রী কর্তৃক একদিনের অমান্য বা স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে অসম্মান দীর্ঘদিনের সংসারজীবন ভেঙ্গে যেতে পারে। ফলে সংসার সুখময় রাখার জন্য বা মনিব-চাকরের সম্পর্ক সঠিক রাখার জন্য সতর্ক থাকা যতটুকু দরকার তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন মহান আল্লাহপাকের ব্যাপারে তাঁর অনুগত বান্দার অর্থাৎ একজন মুসলমানের। একজন মুসলমান সজ্ঞানে আল্লাহ তায়ালার নাফরমানি করতে পারে না কারণ সে আল্লাহকে জানে এবং আল্লাহপাক নিজেও তাঁর গুণাবলী, ক্ষমতা, এখতিয়ার ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে আয়াতুল কুরসি, সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত ও সুরা ইখলাসে আল্লাহপাক নিজেকে এমনভাবে প্রকাশ করেছেন যাতে তাঁর বান্দারা তাঁকে উপলব্ধি করতে পারে এবং ভক্তি, ভয় ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারে।

আল্লাহপাকের একটি গুণ হলো তিনি গোপন ও প্রকাশ্য সকল বিষয়ে জ্ঞাত। লোকচক্ষুর আড়ালে কোনো ভালো বা মন্দ কাজ করলে কেহ না দেখলেও আল্লাহপাক দেখছেন-বান্দাকে এ উপলব্ধি দানের জন্য আল্লাহপাক দীর্ঘ এক মাসব্যাপী রোজা পালন ফরজ করেছেন। একজন মুসলমানের পক্ষে গোপনে বা প্রক্যাশ্যে সুদ, ঘুষ, অর্থ পাচার, গুম-খুন বা আল্লাহপাকের নাফরমানির পর্যায়ে পড়ে এমন কিছু করা কি আদৌ সম্ভব? এককথায় জবাব, না। কারণ সে পরকালের জবাবদিহি ও আল্লাহপাককে ভয় পায়। মুসলমান কোনো বংশ, গোত্র বা মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করাকে বলা হয় না। বরং ঈমান (আল্লাহ, রসুল, কিতাব, আখেরাত, ফেরেশতা, তকদির ও মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান) আনা এবং ঈমানের দাবি অনুসারে নেক আমল করার মাধ্যমেই কেবল মুসলমান হওয়া বা থাকা সম্ভব।

মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়া আমার অভিপ্রায় নয়। বরং ইসলামের রঙে রঙিন হয়ে প্রকৃত মুসলিম হয়ে একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা আমার উদ্দেশ্য। একজন মুসলমানের কাছে সমগ্র সৃষ্টি নিরাপদ। শুধু মানুষ নয়, পশু-পাখী-গাছপালা সবই নিরাপদ। ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত উদার ও ক্ষমাশীল। মানুষকে ক্ষমা করেই তাঁর যতো আনন্দ। সৃষ্টির প্রথম মানুষ আদম (আ.) ও ইবলিস দুজনেই ভুল করেছিল। কিন্তু আদম (আ.) ভুল করার সাথে সাথে ফিরে এসেছিলেন (তওবা করেছিলেন)। ফলে আল্লাহপাক তাঁকে শুধু ক্ষমাই করেননি বরং নবী করে সম্মানিত করেছেন। বান্দা যদি অপরাধ করে ক্ষমা চায় এবং সে অপরাধের পুনরাবৃত্তি না করে তাহলে সে আর শাস্তিযোগ্য থাকে না। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাকে হতাশ হতে নিষেধ করেছেন। ভাবছেন, আপনার বয়স ৫০ এবং জীবনে নামাজ পড়েননি। শুনেছেন প্রতি ওয়াক্ত নামাজ কাজা যাওয়ায় এক হোব্বা দোযখ এবং এক হোব্বা মানে ২ কোটি আটাশি লক্ষ বছর। এমন অংক করে ভাবছেন যে আপনার আর কোনো মুক্তি নেই। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। আপনি তওবা করুন এবং একাগ্রচিত্তে নামাজ শুরু করুন; আশা করা যায় আল্লাহপাক আপনার পেছনের গুনাহ সব মাফ করে দেবেন। বান্দাকে মাফ করার মাঝেই তাঁর বড়ত্ব, মহানত্ব; শুধু প্রয়োজন বান্দার তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করা।

আল্লাহপাক কুরআন মজিদে ঈমান ও নেক আমলের বিনিময়ে জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। শিরকমুক্ত ঈমান ও নেক আমল জান্নাতে যাওয়ার জন্য ন্যূনতম শর্ত। মানুষের বিভিন্ন শ্রেণিভাগ রয়েছে। সবাইকে একই মানদ-ে বিবেচনা করা ইনসাফের খেলাপ। এক বেদুইন এসে রসুলুল্লাহ (সা.)-কে ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ঈমানের সাথে নামাজ, রোজা পালন এবং সামর্থ্য থাকলে জাকাত ও হজ পালনের কথা বলেন। সে বেদুইন চলে যাওয়ার সময় বলে, আমি এর বেশিও করবো না আবার কমও করবো না। চলে যাওয়ার পর রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, লোকটি যদি তার কথায় সত্যবাদী হয় তাহলে সে জান্নাতি। জান্নাতে যাওয়ার জন্য এটি হলো সর্বনি¤œ যোগ্যতা। তবে এটি স্পষ্ট, ইসলাম ছাড়া কেহই যদি অন্য কিছু চায় বা কেহ যদি রাজনীতিতে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বা সমাজতন্ত্রে বিশ^াসী বলে দাবি করে তখন আর তাকে মুসলমান বলার সুযোগ থাকে না।

আল্লাহপাক শেষ নবী (সা.)-এর অনুসারীদের বিশ^শাসনের দায়িত্ব প্রদান করেছেন। আল্লাহপাকের বাণী, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠতম জাতি, তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য, তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দেবে ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে’- সুরা আলে ইমরান ১১০। মানবজাতিকে কল্যাণের পথে নিয়ে আসা এবং অকল্যাণকর যা কিছু আছে তা থেকে দূরে রাখার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রশক্তি। আশার দিক হলো, ইসলামকে রাষ্ট্রীয় দীন হিসাবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ^ব্যাপী ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার এক প্রেরণা তরুণ প্রজন্মের উপলব্ধিতে এসেছে। জাহেলিয়াত যেমন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তার মোকাবেলায় ইসলাম প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করার প্রেরণাও বাড়ছে। দীন কায়েমের দায়িত্ব আল্লাহপাকের। আল্লাহপাক প্রদত্ত শর্ত প্রতিপালিত হলে সে জনপদে তিনি তাঁর দীনকে বিজয়ী করে দিবেন। আল্লাহপাকের বাণী, ‘আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদের দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দীনকে মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যে দীনটি আল্লাহ তাদের জন্য পসন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা যেন শুধু আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে। আর যারা এরপরও কুফরি করবে তারাই ফাসেক’- সুরা নূর ৫৫।

মুসলমানদের বর্তমান আমল-আখলাক বড়ই কদর্যপূর্ণ। আল্লাহপাক যে মানের মুসলমান দাবি করছেন আমরা তা থেকে অনেক দূরে। ব্যবহারিক জীবনে ইসলাম অনুসরণ না করার কারণেই আজ আমাদের এতো জিল্লতি। আমরা মর্যাদার আসনে নেই। আল্লাহপাকের শর্ত খুব বড়ো নয়-শর্ত হলো ঈমান ও নেক আমলে সমৃদ্ধ হওয়া। সততা, বিশ^স্ততা, আমানতদারি, প্রতিশ্রুতি পালন, সদাচার-মৌলিক মানবিক গুণাবলী আজ আমাদের মাঝে বড়ো অভাব। বরং এসব গুণাবলী কাফের-মুশরিকদের মাঝে বেশি দৃশ্যমান। যার ফলশ্রুতিতে আজ তারা আমাদের উপর বিজয়ী। পরিপূর্ণ মুসলমান হওয়া আল্লাহর চাওয়া এবং সেটি হতে পারলে অবশ^ম্ভাবী আল্লাহর সাহায্যও আমাদের চলে আসবে। আল্লাহপাক আমাদের পরিপূর্ণ মুসলিম হওয়ার তৌফিক দান করুন। লেখক : শিক্ষাবিদ।