গাজা এখন কার্যত এক মৃত্যুপুরী। ইসরাইলের লাগাতার হামলা ও অবরোধে গোটা ভূখণ্ড ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, আশ্রয়কেন্দ্রÑকোনো কিছুই আর অক্ষত নেই। লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত, হাজারো শিশু অনাথ। এ বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতেও থেমে নেই দখলদার শক্তির নতুন নতুন নীলনকশা। সম্প্রতি মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা শুধু গাজার মানুষের নয়, বরং গোটা বিশ্বের বিবেককে নাড়া দেওয়ার মতো। সেখানে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল মিলে “গ্রেট” (Gaza Reconstitution, Economic Acceleration, and Transformation)নামের এক প্রকল্প নিয়েছে, যার উদ্দেশ্য হলো গাজার ২০ লাখ অধিবাসীকে অন্তত চার বছরের জন্য দেশছাড়া করা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গাজার মানুষকে অস্থায়ীভাবে মিশর, কাতারসহ কয়েকটি দেশে সরিয়ে নেওয়া হবে। তাদের ভাড়া ভর্তুকি, নগদ অর্থ, ডিজিটাল টোকেন এবং খাবারের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। শুনতে যতই মানবিক মনে হোক, বাস্তবে এটি হলো এক জাতিকে তাদের মাটিচ্যুত করার আরেকটি কৌশল। ফিলিস্তিনের ইতিহাসে এ প্রথম নয়। ১৯৪৮ সালের নাকবা এবং ১৯৬৭ সালের নাকসার পরও একইভাবে লাখো ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই নিয়েছিল। আজ আবার একই ইতিহাস পুনরাবৃত্তির চেষ্টা চলছে।
প্রকল্পের আরেকটি দিক হলো, চার বছর পর গাজাকে একটি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র ও স্মার্ট সিটিতে রূপান্তর করা। বহুতল আবাসন, শিল্পকারখানা, বিমানঘাঁটি, ডেটা সেন্টার, সবুজ এলাকাÑসবই শোনায় চমকপ্রদ। এমনকি জমির মালিকদের ডিজিটাল টোকেনের বিনিময়ে ফ্ল্যাট দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑযখন মানুষকে জোরপূর্বক দেশছাড়া করা হয়, তখন তারা কীভাবে নিজেদের জমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে? যখন তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, তখন কাগুজে টোকেনের মূল্যই বা কতটুকু?
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলোÑএ প্রকল্পে মার্কিন সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না বরং আহ্বান জানানো হবে বিশ্বের ধনকুবেরদের কাছে, সর্বনিম্ন ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের শর্তে। অর্থাৎ গাজার দুর্ভোগকে পুঁজি করে এক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলছে। বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ পরিকল্পনাকে ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চান। মানবিক বিপর্যয়কে পুঁজি করে যখন কারও মুনাফা হাসিল হয়, তখন সেটি কেবল অমানবিকই নয়Ñবরং অপরাধ।
ফিলিস্তিন প্রশ্ন নিছক কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয় নয়। এটি একটি জাতির অস্তিত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন। আজকের শিশুদের ভবিষ্যৎ, তাদের পরিচয়, তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকার এখানে জড়িত। গাজার ধ্বংসস্তূপে স্মার্ট সিটি গড়ার স্বপ্ন দেখানো মানে হলোÑফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে চিরতরে স্তব্ধ করার চেষ্টা। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে দখলদার ইসরাইল ও তাদের পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র আসলে ফিলিস্তিনের প্রশ্নকে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে মুছে ফেলতে চাইছে।
এমন পরিস্থিতিতে নীরব থাকা মানে হলো অন্যায়ের অংশীদার হওয়া। আরব বিশ্ব, মুসলিম উম্মাহ ও মানবাধিকারের পক্ষের শক্তিগুলোকে এখনই একযোগে প্রতিবাদ করতে হবে। গাজার পুনর্গঠন অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তা হতে হবে গাজার জনগণের নিয়ন্ত্রণে এবং তাদের রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েই। বহিরাগত বিনিয়োগকারী বা দখলদার শক্তির শর্তে নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্পষ্ট ভাষায় বলতে হবেÑগাজা কোনো বিনিয়োগ প্রকল্প নয়, এটি একটি জাতির জন্মভূমি। আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের তথাকথিত “গ্রেট” পরিকল্পনা ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে এক নতুন ষড়যন্ত্র। এর লক্ষ্য পুনর্গঠন নয়, বরং চিরতরে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ ও তাদের স্বাধীনতার দাবি ধ্বংস করা। গাজার পুনর্গঠন তখনই অর্থবহ হবে যখন তা ফিলিস্তিনি জনগণের ইচ্ছা, অধিকার ও নিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। আন্তর্জাতিক মহলের উচিত গাজার ধ্বংসস্তূপে নতুন নগরী নয়, বরং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়া।