গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশে আরও তিনজনের মৃত্যু এবং প্রায় ৫০০ জনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সোমবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট প্রাণহানি দাঁড়িয়েছে ৪৮ জনে, আর আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজার ৭৬৩ জন। শুধু গত একদিনেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৯২ জন, যাদের ৮০ শতাংশের বেশি অর্থাৎ ৪০৩ জনই ঢাকার বাইরের জেলার বাসিন্দা।
ডেঙ্গু শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক সমস্যা নয়Ñএটি এখন একটি জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিচ্ছে। চলতি বছর শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর দায়িত্বহীনতা, জলাবদ্ধতা এবং আবর্জনার সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব একত্রে মশাবাহিত এ রোগের বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এতে প্রমাণ হয়, ডেঙ্গু প্রতিরোধে গৃহীত উদ্যোগসমূহ এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক দুর্বল ও খ-িত। আমরা লক্ষ্য করছি, ডেঙ্গুর সংক্রমণ এখন রাজধানী ঢাকার সীমানা ছাড়িয়ে জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রামীণ জনপদেও বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। এ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আক্রান্তদের একটি বড় অংশই ঢাকার বাইরের, যা ইঙ্গিত দেয় যে, স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগ পর্যায়ে প্রস্তুতি ও জনসচেতনতা কর্মসূচির ঘাটতি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, বর্ষাকাল ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মশার প্রজননক্ষেত্র বাড়বে, যা ডেঙ্গুর বিস্তারকে ত্বরান্বিত করবে। অথচ সঠিক সময়ে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু না করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরের মতোই বিলম্ব করেছে। ফগিং মেশিন চালানো কিংবা প্রচারপত্র বিলি করলেই কাজ শেষ হয় নাÑপ্রয়োজন ধারাবাহিক, কার্যকর ও প্রযুক্তিনির্ভর পদক্ষেপ। ডেঙ্গু প্রতিরোধে শহর ও গ্রাম পর্যায়ে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়ন, পরিত্যক্ত কন্টেইনার বা জমে থাকা পানি সরানোর ব্যাপারে ব্যাপক অভিযান এবং স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০২৪ সালেও ডেঙ্গুতে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। সে অভিজ্ঞতা থেকে পর্যাপ্ত শিক্ষা গ্রহণ না করায়, ২০২৫ সালেও একই সংকট আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আমরা মনে করি, এখনই সময় একটি সমন্বিত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণেরÑযেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ এবং জনসাধারণ সবাই একযোগে কাজ করবে। বিভিন্ন দফতর এমনকী সিটি কর্পোরেশনগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব না থাকায় এবং অনেকক্ষেত্রে নিযুক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যথেষ্ট সহায়তা না পাওয়ায় জটিলতা বাড়ছে। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদ নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চলার কারণে সাধারণ সেবা কার্যক্রম বিঘিœত হয়েছে। এই সময়ে মশার ঔষধ ছেটানো এবং অন্যান্য প্রাক-প্রস্তুতি কার্যক্রম ব্যহত হয়েছে যা শহরে ডেঙ্গু রোগের বিস্তারের অন্যতম নেপথ্য কারণ।
স্বাস্থ্যখাতে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে হলে শুধু রোগীর চিকিৎসা নয়, রোগ প্রতিরোধেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। স্থানীয়ভাবে কীটনাশক ছিটানো, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং মশার লার্ভা ধ্বংস করা ছাড়া ডেঙ্গু মোকাবিলা সম্ভব নয়। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারখানাগুলোতেও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো জরুরি। প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনী কিংবা র্যাবকে দিয়েও দূষিত ও মশা বহুল এলাকাগুলোতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে।
ডেঙ্গুতে একজন মানুষের মৃত্যু মানে শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়Ñএটি একটি পরিবারে বিপর্যয়, রাষ্ট্রের জন্য ব্যর্থতা। তাই মৃত্যুর এই সংখ্যা ৪৮-এ সীমাবদ্ধ না থেকে কয়েক গুণ বৃদ্ধি না পায়, সে জন্য এখনই দায়িত্বশীলদের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা আশা করি, সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে চরম আন্তরিকতা ও কঠোরতা দেখাবে, যেন ডেঙ্গু নামক ভয়াবহ দুর্যোগ আমাদের এখানে মহামারীর রূপ ধারণ না করে।