ভারত, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র, বহু ধর্ম, ভাষা এবং সংস্কৃতির মিলনস্থল। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরে ভারতীয় সংবিধান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সমতা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী, যাঁরা সংখ্যায় প্রায় ২০ কোটি, ক্রমশ প্রান্তিকতার শিকার হচ্ছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁদের অধিকার ও মর্যাদা সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ভারতীয় মুসলিমদের বর্তমান পরিস্থিতি শুধু একটি সম্প্রদায়ের সংকট নয়; এটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির প্রতি এক বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে দৈনিক সংগ্রামে গত ১৮ আগস্ট একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৯ সালে পাস হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) প্রথমবারের মতো ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্বের মানদ- তৈরি করে। এ আইন শুধু মুসলিমদের বাদ দিয়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং নাগরিকত্ব নিয়ে এক নতুন অনিশ্চয়তা এবং বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে। এর ফলে দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী, যাঁদের অধিকাংশের হাতে পর্যাপ্ত নথিপত্র নেই, নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন। রাজনৈতিকভাবে মুসলিমদের প্রান্তিককরণ আরও স্পষ্ট। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ শনাক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর ফলে মুসলিমদের ভোটাধিকার এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও মুসলিমদের প্রান্তিককরণ দেখা যাচ্ছে। বিজেপির ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ শনাক্ত করার প্রতিশ্রুতি মূলত বাঙালি মুসলিমসহ পূর্ব ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে। এটি “আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদ” এর অংশ, যা মুসলিমদের “বহিরাগত” বা “দেশদ্রোহী” হিসেবে চিহ্নিত করে হিন্দু ভোট ব্যাংক সংহত করার চেষ্টা করে। এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস) ও সিএএ (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) এর মতো নীতির প্রেক্ষিতে এই প্রতিশ্রুতি মুসলিমদের মধ্যে গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আসামে এনআরসি বাস্তবায়নের সময় ১৯ লাখ মানুষ (যাদের অধিকাংশ মুসলিম) নাগরিকত্বহীন ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই এই আশঙ্কা বাড়ছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেখানে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার থাকা উচিত, সেখানে এ ধরনের উদ্যোগ একটি সম্প্রদায়ের জন্য গভীর সংকট তৈরি করছে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও মুসলিমরা এক ধরনের অবক্ষয়ের মুখোমুখি। উর্দু ভাষা, যা একসময় ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ ছিল, তা আজ ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে। সিনেমা, মিডিয়া, এবং দৈনন্দিন জীবনে মুসলিমদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে মুসলিম যুবসমাজের মধ্যে এক ধরনের হতাশা এবং বিচ্ছিন্নতার বোধ জন্ম নিচ্ছে।
অতীত থেকে শিক্ষা নিলে বোঝা যায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর প্রতি রাষ্ট্রের নীতি যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, তাহলে তা শুধু সামাজিক বৈষম্যই নয়, বরং রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক সংকটও সৃষ্টি করে। মুসলিম লীগের পূর্বাভাস অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ভারতীয় মুসলিমদের সাংবিধানিক সুরক্ষার অভাব এবং সামাজিক বৈষম্যের আশঙ্কা আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। তবে এ সংকটের সমাধান সম্ভব। ভারতীয় সংবিধান যে সমতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রকে সক্রিয় হতে হবে। মুসলিমদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত করতে হবে, যাতে তাঁরা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পান।
একইসঙ্গে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় উর্দু ভাষার প্রসার এবং মুসলিমদের সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ভারতীয় মুসলিমদের সংকট কেবল তাঁদের নিজস্ব সমস্যা নয়; এটি পুরো দেশের গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন। একটি জাতি তখনই উন্নতি করতে পারে, যখন তার প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সমানভাবে রক্ষিত হয়। তাই মুসলিমদের নাগরিক অধিকার এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই আজ ভারতের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।