বর্তমানে আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যখন বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি এবং প্রযুক্তির গতিবিধি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, শ্রমবাজারের রূপান্তর-সবকিছুই প্রতিনিয়ত নতুন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে। এমন পটভূমিতে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হয়ে উঠেছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং দেশবান্ধব রাজনীতির ধারা। বিগত সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসন কেবল মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণেরই কারণ হয়েছে। লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়েও আওয়ামী লীগ দেশে স্থিতিশীলতা তৈরির চেয়ে বরং বিভাজনের রাজনীতি করতেই বেশি তৎপর ছিল। প্রতিপক্ষের বিনাশ ছিল আওয়ামী লীগের প্রধানতম এজেন্ডা।

গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগের সে বিভাজনের রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করেছে। অসংখ্য জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে মানুষ একটি দেশবান্ধব রাজনীতির পথ উন্মোচন করেছে। বিপ্লবের পর এক বুক আশায় বুক বেঁধেছিল এ দেশের মানুষ। কিন্তু বিপ্লবের ৯ মাস পর এসে দেখা যাচ্ছে আবারও যেন রাজনীতি ব্যক্তিস্বার্থ আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক দখলদারিত্বেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। জাতীয় স্বার্থ, সাধারণ জনগণের জীবনের মানোন্নয়ন কিংবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই পরিকল্পনা-এ বিষয়গুলো রাজনীতির কেন্দ্র থেকে ক্রমেই ছিটকে যাচ্ছে।

জনগণের মূল দাবি সংস্কার এবং বিচারের পর নির্বাচন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো করছে। এত জীবনের কুরবানি হলো কিন্তু এ বিষয়টিই যেন এখন আমাদের আলোচনা থেকে ক্রমশ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। দেশে-বিদেশে ফ্যাসিবাদের দোসরেরা এখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করছে। আর ফ্যাসিবাদ বিরোধী দলগুলোও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এক ধরনের তাড়াহুড়ো করছে, অন্তর্বর্তী প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে; প্রশাসনের নানা সেক্টরে দুরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির অবকাশ তৈরি করে দিয়েছে। এতে করে একদিকে যেমন ফ্যাসিবাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরেও এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।

আওয়ামী লীগ যেভাবে প্রশাসনিক ও নির্বাচনী কাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে তা এখনো জাতীয় রাজনীতিতে বড়ো ধরনের শূণ্যতা তৈরি করে রেখেছে। এমতাবস্থায় নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রত্যাশিত সংস্কার অপরিহার্য; পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ, পরস্পরের প্রতি সম্মান এবং নির্বাচন কমিশনের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। নির্বাচনের আগেই প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের ব্যবহার, মামলা-গ্রেপ্তারের রাজনীতি, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ-এসবই গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এসব থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের দরকার একটি সহনশীল ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে সরকার এবং বিরোধী দল উভয়ই গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ তরুণ। তারা চায় কর্মসংস্থান, উদ্ভাবনের সুযোগ, ন্যায়বিচার এবং মুক্ত মত প্রকাশের অধিকার। কিন্তু রাজনীতির বৃত্তে এ তরুণদের অংশগ্রহণ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। তারা রাজনীতিতে আস্থাহীন, কারণ তারা দেখতে পায় দুর্নীতি, দলীয়করণ এবং আদর্শহীন চর্চা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দরকার একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে তরুণদের মতামত, চিন্তা ও নেতৃত্বের স্থান থাকবে। রাজনীতিতে অস্থিরতা দেখতে দেখতে এদেশের মানুষ এখন ক্লান্ত। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সংকট ও বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানের পথ একটাইÑজাতীয় স্বার্থে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্মানজনক সংলাপ, সমঝোতা ও বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ। মতপার্থক্য থাকবে, সেটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু সে মতপার্থক্য যেন বিভাজন ও সংঘাতে না গিয়ে গঠনমূলক আলোচনায় রূপ নেয়, সেটি নিশ্চিত করা দরকার। আমরা এমন একটি রাজনীতি চাই যেখানে মানুষ বিভক্ত হবে না, বরং ঐক্যবদ্ধ হবে; যেখানে দলীয় পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে উঠবে নাগরিক পরিচয়; যেখানে ক্ষমতা নয়, কর্তব্য হবে মুখ্য। একটি পরিণত, প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও দেশবান্ধব রাজনীতিই পারে দেশকে সত্যিকার অর্থে স্মার্ট, সমৃদ্ধ ও টেকসই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে নিতে।