মানুষের সমস্যার পেছনে লক্ষ্য করা যায় মানুষের কর্মকাণ্ড। আবার প্রকৃতির সমস্যার পেছনেও দাঁড়িয়ে আছে মানুষই। অবশ্য সমস্যা সৃষ্টির পেছনে সব মানুষের দায় এক রকম নয়। যে যত বড়, তার দায় তত বেশি। মানুষ জানে তার কী করা উচিত, কোন পথে চলা সঙ্গত। কিন্তু সে উচিত কর্ম করে না, সঙ্গত পথেও চলে না। এমন পথভ্রষ্টার কারণ কী? পথ ভ্রষ্টতার পেছনে মানুষের জীবনদর্শন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জেনেশুনেও যারা অন্যায় করছেন, সমস্যা সৃষ্টি করছেন-তারা তো খুবই সাহসী মানুষ। কিন্তু এ সাহস তারা কোত্থেকে পাচ্ছেন? এখানেই চলে আসে জীবনদর্শনের প্রশ্ন। যারা সেক্যুলার তথা ইহলৌকিকবাদী, তাদের জীবন-যাপন ইহলোককে কেন্দ্র করেই। ইহলোকেই তাদের শুরু, ইহলোকেই তাদের শেষ। ইহলোক শেষে যে আর এক ‘লোক’ আছে, পরলোক আছে; তাতে তাদের আস্থা নেই। পরলোক তথা অনন্তলোকে অবিশ্বাসী মানুষের চিন্তা-চেতনা খুবই সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। দুনিয়ার আয়-উপার্জন ও ভোগ-উপভোগের মধ্যেই তারা আবর্তিত হন। পরকাল তথা আখেরাতে মহান স্রষ্টার আদালতে জবাবদিহিতার দায় না থাকায় সেক্যুলার মানুষ খুবই সাহসী হয়ে ওঠেন। এ সাহস তাদের প্রোডাক্টিভ তথা উৎপাদনশীল হতেও সাহায্য করে থাকে। সেক্যুলারদের এই যে প্রোডাক্টিভিটি, সেখানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি থাকে, চাতুর্য থাকে; কিন্তু থাকে না নৈতিকতা কিংবা মানবিকবোধ। আইনি বিধান ও তার প্রয়োগকে পাশ কাটাতে কিংবা অবজ্ঞা করতে পারলে, যে কোনো অন্যায় ও নিষ্ঠুর কর্মে সেক্যুলাররা বেশ স্মার্ট হয়ে ওঠেন। বর্তমান সভ্যতা তার বড় প্রমাণ। আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় আইন সবার জন্য এক রকম নয়। শক্তির তারতম্যের কারণে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগেও তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেই পরাশক্তি ভূরাজনীতির নামে তাদের নিষ্ঠুর আগ্রাসন চালিয়ে যেতে পারছে। ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গাজায় যা ইচ্ছে তা করতে পারছে। আইন কোথায়ও প্রবাহমান থাকে, কোথায়ও অবশ হয়ে পড়ে। পরলোকে জবাবদিহীতার চেতনাবিহীন বর্তমান সভ্যতায় মানুষের সম্মানজনক বসবাস তাই অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
বর্তমান সভ্যতার চিত্রটা আসলে কেমন? এ সভ্যতা তো মানববান্ধব নয়, প্রকৃতিবান্ধবও নয়। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অনৈতিক চর্চায় প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের কি হাল হয়েছে? জলবায়ু সংকট, বায়ুদূষণ, কার্বনপ্রবাহ ও ওজনলেয়ারে সংকটের জন্য কারা দায়ী। শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো অভিযুক্ত হওয়ার পরও দায় মেটাতে সঙ্গত ভূমিকা পালন করছে না। তারা চাতুর্য ও কূটনৈতিক কৌশলে বছরের পর বছর ধরে দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। পরকালে অবিশ্বাসী সেক্যুলাররা নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব পালনে সবসময় অক্ষম। আসলে যেখানে জবাবদিহীতা নেই, সেখানে ন্যায় নেই; নেই মানবাধিকারও। এ সভ্যতা প্রকৃতিবান্ধব নয়, মানববান্ধবও নয়। সভ্যতার শাসকদের অনৈতিক আচরণে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সৃষ্টি হয়েছে আস্থার সংকট। কূটনৈতিক বৈঠকে একসাথে পানাহার করলেও তারা অন্তরে লালন করছেন বিদ্বেষ। এই বিদ্বেষ তাদের নিয়ে গেছে মারণাস্ত্র তৈরির বিপদসঙ্কুল প্রতিযোগিতায়। এ প্রতিযোগিতা পৃথিবীকে বহুবার ধ্বংস করার সক্ষমতা দিয়েছে তাদেরকে। অথচ ট্রাজেডি হলো, একবার ধ্বংস হবার পর পৃথিবীতে আর কেউ বেঁচে থাকবেন কী? পৃথিবীতে এখনো চলছে বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কিংবা প্রোডাক্টিভিটি এ ক্ষেত্রে কোনো অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে না; বরং যুদ্ধবিগ্রহের দিকেই ধাবিত করছে মানবজাতিকে।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা এবং প্রোডাক্টিভিটিতো মানবজাতিকে সমৃদ্ধ জীবন উপহার দিতে পারতো। কিন্তু তেমনটি তো হলো না, বরং এ প্রোডাক্টিভিটি মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার করেছে। যারা পারমাণবিক শক্তিতে বলীয়ান তারা যেন এখন ভয়ানক দানব, আর বাকিরা অসহায় প্রাণী। নৈতিকতা, মানবিকতা, এ সভ্যতায় লোপ পেয়েছে। ফলে কেউ আর মানুষ নেই, এ সভ্যতায় কেউ কেউ দানব, বাকিরা যেন প্রাণী। মানুষের সভ্যতায় এমন বিপর্যয় কেমন করে ঘটলো? ইতিহাসের পাঠক মাত্রই জানেন, বর্তমান সভ্যতার মূলে ছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁ। রাজা, অভিজাত সম্প্রদায় ও ধর্মজাযকরা মিলে যে অশুভ শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছিল; তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু ন্যায়সঙ্গত এ কাজটি করতে গিয়ে রেনেসাঁর নেতারা একটি বড় ভুল করে ফেলেছিলেন। তাঁরা কিছু ধর্মজাযকের অন্যায়কে চাপিয়ে দিলেন ধর্মের ওপর। ধর্মকে বিদায় করলেন জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে। ধর্ম যা করতে বলেনি, তার দায় ধর্মের ওপর চাপিয়ে দেয়া কি অন্যায় নয়? এটি কি এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীলতা নয়? এ প্রতিক্রিয়াশীলতার বিষফল এখন ভুগছে পুরো মানবজাতি। সেক্যুলার মানুষ যখন স্রষ্টাকে অমান্য করে, তখন পরকাল ও জবাবদিহিতার বিষয় লুপ্ত হয়ে যায়। তখন সমাজে, রাষ্ট্রে, বিশ্বব্যবস্থায় আবির্ভূত হয় বহু ছোট ছোট প্রভু। এরা নিজ নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থে নিষ্ঠুর ও অমানবিক হয়ে ওঠে। বিশ্ব ও মানবজাতিকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব দেয়ার মত সামর্থ্য তাদের থাকে না। বর্তমান সভ্যতা তার বড় প্রমাণ।
বর্তমান সভ্যতার যে প্রোডাক্টিভিটি তার ভিত্তি আসলে কী? শিকড়ে গেলে তিনটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। ১. বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অন্ধ বিস্তার। ২. চার্চ তথা ধর্ম থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করা। ৩. ‘পারসোয়েড অব ম্যাটেরিয়ালিজম’ অর্থাৎ টাকার পেছনে ছুটতে মানুষকে প্ররোচিত করা। এ তিনটি বিষয় আমাদের কেমন সভ্যতা উপহার দিল? মানবজাতিকে কোথায় পৌঁছে দিল? আমাদের পৃথিবীতে ভূরাজনীতির চিত্রটা। এখন কেমন? অর্থনীতি ও বন্টনব্যবস্থা কি মানবিক? দুর্বল রাষ্ট্রের মানুষগুলো কি বেঁচে থাকার মত অবস্থায় আছে? কিছু রাষ্ট্র কেন দানব হয়ে উঠলো? বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কেন এত অপব্যবহার? মারণাস্ত্রের বিপুল ধ্বংস ক্ষমতা কি অহংকার করার মত কোনো বিষয়? সেক্যুলার চেতনায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অপব্যবহারে প্রাকৃতির বিপর্যয় ও জলবায়ু সংকট কেন সৃষ্টি করা হলো? আসলে মানুষ যখন প্রকৃত প্রভুকে ভুলে গিয়ে নিজেরাই প্রভু হয়ে ওঠে, তখন পৃথিবী ও মানবজাতি এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সঙ্গত প্রশ্নের জবাব দেয়ার সামর্থ্যও সভ্যতার শাসকদের থাকে না।
মানবজাতি তো কোনো না কোনো সভ্যতায় বসবাস করে থাকে। বর্তমান সভ্যতা মানবিক জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এ সভ্যতা মানববান্ধব নয়। অথচ মহান স্রষ্টাতো পৃথিবীকে মানববান্ধব করেই সৃষ্টি করেছেন। তাহলে সংকট সৃষ্টি করলো কে? আসলে সংকট সৃষ্টি করেছে সেক্যুলার সভ্যতার ধ্বজাধারীরা। তাদের যদি জীবনের সীমাবদ্ধতা তথা মৃত্যুর কথা স্মরণ করাতে চান, তারা সে কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেনÑ আরে, জীবনটা উপভোগ করতে দাওতো। যে স্রষ্টা পৃথিবীকে মানববান্ধব করে সৃষ্টি করেছেন, এত উপায়-উপকরণ ও নেয়ামত দিয়েছেন; সে স্রষ্টা তো জীবনটা উপভোগে বারণ করেননি। বরং দিয়েছেন জীবনকে সঠিক ও মর্যাদাপূর্ণভাবে উপভোগের কিছু শৃংখলা ও সহজ বিধিবিধান। এ পর্যায়ে এসে আবার প্রোডাক্টিভিটির আলোচনা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রোডাক্টিভিটি তথা উৎপাদনশীলতার সাথে ভোগ-উপভোগের বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত। আগে আমরা সেক্যুলার প্রোডাক্টিভিটির তিনটি ভিত্তি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। এখন আমরা জানতে চাইবো মানবিক সভ্যতার প্রোডাক্টিভিটি তার ভিত্তি ও স্বরূপ সম্পর্কে।
এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন পয়গম্বরদের ধারাবাহিকতায় শেষ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (স.)। তিনি বলেছেন, পরকালে হাশরের ময়দানে মানুষকে পাঁচটি বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। প্রশ্ন করা হবে- ১. জীবনটা কীভাবে কাটিয়েছো? ২. যৌবনটা কীভাবে ব্যয় করেছো? ৩. সম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছো? ৪. সম্পদ কীভাবে ব্যয় করেছো? ৫. অর্জিত জ্ঞান কীভাবে ব্যবহার করেছো? লক্ষ্য করে দেখুন, এই পাঁচটি প্রশ্ন মূলত প্রোডাক্টিভিটির সাথে সম্পর্কিত। এ প্রশ্নগুলো মানুষকে সতর্ক করে পুরো জীবনের প্রোডাক্টিভিটি সম্পর্কে। মানুষ অলসভাবে জীবনযাপন করতে পারে না। প্রবৃত্তির তাড়নায়ও জীবনযাপন করতে পারে না। বান্দা হিসেবে স্রষ্টার বিধানের আলোকে মানুষকে সক্রিয় তথা প্রোডাক্টিভ হতে হবে। মানুষ কখনো মানুষের প্রভু হবে না বরং মহান স্রষ্টার বান্দা হিসেবে আনুগত্যের শৃংখলায় জীবনযাপন করবে। এমন জীবনযাপনে জবাবদিহিতার ভয় থাকবে। রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক, অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, প্রশাসন, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ধর্মজাযক , কৃষক-শ্রমিক, সবাই থাকবেন জবাবদিহিতার আওতায়। জবাবদিহিতার এমন সভ্যতা অবশ্যই উত্তম হবে বর্তমান সেক্যুলার সভ্যতা থেকে।