জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিউইয়র্ক সফরে গিয়েছেন- এটি ছিল জাতীয় মর্যাদার একটি ঘটনা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তার আগমন উপলক্ষে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের মুখোমুখি অবস্থান বিদেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের এক অনাকাক্সিক্ষত অশান্ত পরিবেশের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে।

রোববার রাতে জ্যাকসন হাইটসে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি স্লোগানে পুরো এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। স্থানীয় পুলিশ এসে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সরিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য হয়। এমনকি রাত ১০টার দিকে আওয়ামী লীগের এক কর্মী ও আওয়ামী লীগ বিরোধী এক ভিডিও ব্লগারের পরস্পরের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও এলাকা থেকে সরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার না হলেও, পুরো পরিস্থিতি প্রমাণ করে দিয়েছে বিদেশের মাটিতেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি কতটা সহিংস, কুৎসিত এবং অনভিপ্রেত।

আমেরিকা ও ব্রিটেনের মতো উন্নত দেশগুলো নিজেদের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা নিয়ে গর্ব করে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সমাবেশ করার অধিকার নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের প্রাণ। কিন্তু এ স্বাধীনতার নামে যদি অতিথি হয়ে আসা কোনো দেশের প্রতিনিধি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তবে সেটি গুরুতর ব্যর্থতা। প্রধান উপদেষ্টা ও তার সফরসঙ্গীরা বৈধ ভিসা নিয়ে সেখানে গেছেন। তারা কেবল অতিথিই নন, বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীকও বটে। অথচ তাদের সফরকে ঘিরে নিরাপত্তাজনিত হুমকি দেখা দেওয়াটা প্রমাণ করে, উন্নত দেশগুলো প্রবাসে রাজনৈতিক সংঘাত নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারছে না।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও দমননীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রবাসেও রপ্তানি করা হচ্ছে। বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরা সাধারণত কঠোর পরিশ্রম করে সমাজে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে চান। তাঁরা সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ, আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সামাজিক মর্যাদার জন্য কাজ করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সংঘাতমুখী রাজনীতি তাদের জীবনযাত্রায় বিভক্তি ও অশান্তি ডেকে আনছে। প্রবাসের শান্ত পরিবেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আমদানি করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কেবল নিজেদের নেতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করছে না, বরং দেশের ভাবমূর্তিকেও কলঙ্কিত করছে।

আওয়ামী লীগের কুৎসিত কর্মকা-ের পাশাপাশি আওয়ামী বলয়বিরোধী দলগুলোরও কৌশলগত সীমাবদ্ধতা আছে। আওয়ামী লীগের আগ্রাসী তৎপরতা আগেভাগেই অনুমান করা সম্ভব ছিল। কিন্তু বিরোধী দলগুলো কার্যকর পাল্টা কৌশল গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। শুধুমাত্র পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় না। বিদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চক্রান্ত মোকাবিলা করতে হলে সংগঠিত, পরিকল্পিত ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ প্রয়োজন। সবচেয়ে হতাশাজনক দিক হলো বাংলাদেশের দূতাবাস ও কনস্যুলেটের ভূমিকা। প্রবাসীদের যেকোনো সমস্যায় তাদের পাশে দাঁড়ানোই দূতাবাসের দায়িত্ব। অথচ এ ঘটনার ক্ষেত্রেও তারা নির্লিপ্ত থেকেছে। বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমনে দূতাবাস কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। এ ধরনের অবস্থান দূতাবাসের নিরপেক্ষতা ও দায়িত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

আমরা মনে করি, বিদেশে বসে যারা আওয়ামী লীগের নামে সংঘাত সৃষ্টি করছে, তারা মূলত দেশের ভাবমূর্তিকেই কলঙ্কিত করছে। রাজনৈতিক বিরোধিতার নামে সহিংসতা ও অশান্তি সৃষ্টি না করে বিদেশের মাটিতে সকল দলকে অন্তত দেশের স্বার্থে সংযম প্রদর্শন করতে হবে। বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও দেশের মর্যাদা রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। আওয়ামী লীগের কুৎসিত রাজনীতি দেশে যেমন অশান্তি সৃষ্টি করেছে, বিদেশেও তা রপ্তানি করা হচ্ছে-এটি জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি। এখন সময় এসেছে সব পক্ষকে উপলব্ধি করার যে, বিদেশে রাজনৈতিক সংঘাত নয়; বরং দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি রক্ষা করাই হওয়া উচিত প্রধান লক্ষ্য।