দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা সোনালি বিবি এখন ‘রাষ্ট্রহীন’। কয়েক সপ্তাহ আগে স্বামী, আট বছরের ছেলেসহ তাকে দিল্লি থেকে আটক করেছিল পুলিশ। পরে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ সন্দেহে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো (পুশইন) হয়। গত বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। ২৯ বছর বয়সী সোনালি বিবির পৈতৃক বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায়। তবে দু’দশক ধরে তারা দিল্লিতে বসবাস করছিলেন। তার পরিবারের সদস্যরা সেখানে ভাঙারি কুড়ানো এবং গৃহকর্মীর কাজ করতেন। দিল্লি থেকে বীরভূমের আরেকটি পরিবারকেও আটক করা হয়েছে। এ পরিবারের সদস্যরা হলেন সুইটি বিবি (৩২) ও তার দু’ছেলে, যাদের বয়স ৬ ও ১৬ বছর। দিল্লি থেকে দু’পরিবারকে আটক করা হয় প্রায় একই সময়ে। প্রথমে তাদের দিল্লির কে এন কাতজু মার্গ থানায় আটক রাখা হয়েছিল। পরে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এমন সময় এ ঘটনা ঘটলো, যখন কলকাতা হাইকোর্টে দু’নারীর পরিবারের দায়ের কথা হেবিয়াস কর্পাস আবেদনের শুনানি চলছে। হেবিয়াস কর্পাস শুনানিতে কাউকে আইনবহির্ভূতভাবে আটক করা হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হয়।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার রেজাউল করিম বৃহস্পতিবার ফোনে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘তাদের ভারতের আসাম সীমান্তবর্তী কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছিল। এরপর তারা কিছুদিন ঢাকায় ছিলেন। সেখানে বেশির ভাগ সময় রাস্তার ওপর থেকেছেন। এক মাস ধরে তারা চাঁপাইনবাবগঞ্জে থাকছিলেন। আমরা তাদের গ্রেপ্তার করেছি।’ পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সোনালি ও তার পরিবারের কাছ থেকে ভারতীয় নথিপত্র পাওয়া গেছে। শুক্রবার তাদের আদালতে হাজির করা হয়েছে। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী সব আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। যেহেতু এখানে নারী ও শিশু রয়েছে, তাই আমরা বিষয়টি যথাযথ সম্মান ও সহানুভূতির সঙ্গে সামাল দিচ্ছি।
বাংলাদেশে সোনালি ও সুইটি পরিবারের গ্রেপ্তারের ঘটনা ‘গভীর উদ্বেগের’ বলে উল্লেখ করেছেন ওয়েস্ট বেঙ্গল মাইগ্রাণ্ট লেবার ওয়েলফেয়ার বোর্ডের চেয়ারম্যান সমীরুল ইসলাম। রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের এ সদস্য বলেন, ‘সোনালি অন্তঃসত্ত্বা। তাদের সঙ্গে শিশুও রয়েছে। তারা সবাই পশ্চিবঙ্গের বাসিন্দা। সব ধরনের আইনি উপায়ে আমরা তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবো।’ উল্লেখ্য, সোনালি ও সুইটিদের আটকের আগে থেকেই গুজরাট, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে কথিত অবৈধ বাংলাদেশি আটকের অভিযান চালাচ্ছে ভারতের পুলিশ। এসব অভিযানে বেশ কিছু বাংলাভাষী শ্রমিককে আটক করা হয়েছে। কিন্তু আটক এসব ব্যক্তির অনেকেই তাদের পৈতৃক বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বলে দাবি করছেন।
ভারতের বীরভূমের অন্তঃসত্ত্বা নারী সোনালি বিবি ও তার পরিবারকে বাংলাদেশে পুশইন করেছে বিএসএফ। বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনেরও। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ‘ভাষাগত বিদ্বেষ’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। অমর্ত্য সেন মজা করে বলেন, আমাকেও ঢাকায় ফেরত পাঠানো হতে পারে, কারণ সেখানে আমার পরিবারের শিকড় রয়েছে।’ বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীদের বাংলাদেশী অভিবাসী বলে যে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন অমর্ত্য সেন। তিনি বলেন, বাংলাভাষীদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। গত শুক্রবার কলকাতায় ভারতীয় তরুণদের নিয়ে এক আলোচনায় তিনি বলেন, আমি সংবাদপত্রে দেখেছি যে একজনকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। কারণ সে বাংলায় কথা বলছিলো। এটা আমাকে কিছুটা চিন্তিত করে তুলেছে।
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বাংলাভাষী ব্যক্তিদের ওপর হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে অমর্ত্য সেন ভারতীয় সভ্যতার বৈচিত্র্যের ওপর জোর দিয়ে বলেন, বাঙালি এবং পাঞ্জাবিসহ প্রতিটি সাংস্কৃতিক পরিচয়েরই উদযাপনের কারণ রয়েছে। এমন বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ভারতীয় সংবিধানের দর্শনকেই তুলে ধরেছেন। যেখানে ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ধর্ম ও ভাষার পার্থক্যের কারণে কেউ নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। অথচ বঞ্চিত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সোনালি বিবি। তাকে বাংলাদেশে জোরপূর্বক পুশইন করা হয়েছে। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা সোনালি বিবি এখন ‘রাষ্ট্রহীন’। আশা করি তিনি বঞ্চিত হবেন না, রাষ্ট্রহীনও থাকবেন না, ভারতের নাগরিক সমাজ তার নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হবেন।