শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক দলিল ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা কেবল একটি বইয়ের প্রকাশনা নিয়ে নয়; এটি একটি রাষ্ট্রের প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে কতটা গভীরভাবে রাজনীতিকরণ করার তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীসহ ১২৩ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা নজরদারি শুধু একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়; এটি একটি সময়ের প্রতীক, যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিল।
দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ মুজিবের জীবনের ওপর রচিত এ বইটির মূল পা-ুলিপি সম্পাদনার নামে সাবেক পুলিশ প্রধান জাবেদ পাটোয়ারী ও তার দল সরকারি পদ, কোটি টাকার ফ্ল্যাট ও নগদ অর্থ পেয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা সরকার প্রধানের পিতার একটি বই রচনার ক্ষেত্রে সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব যদি রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে পদ-পদবি ও আর্থিক পুরস্কারের মাধ্যমে ছাড়া হয়, তবে তা নি:সন্দেহে প্রশাসনের রাজনীতিকরণের প্রকট দৃষ্টান্ত। এখানে দুটি গুরুতর বিষয় সামনে এসেছে। প্রথমত, এরকম বই রচনা বা সম্পাদনায় ইতিহাসবিদ, গবেষক ও ভাষাবিদদের দক্ষতাকেই অগ্রাধিকার দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা শুধু অদক্ষতাই নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে দেখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বইটি প্রকাশের সময় দাবি করা হয়েছিল, এটি স্বয়ং শেখ মুজিবের মূল খাতা থেকে সম্পাদিত। কিন্তু বর্তমান অভিযোগ উঠেছে যে, এটি আসলে লেখা হয়েছে জাবেদ পাটোয়ারী ও তার দলের হাতে। এতে ঐতিহাসিক নথির বিশুদ্ধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে, যা জাতির ইতিহাসকেই বিতর্কিত করে।
এ ঘটনা আরও একবার প্রমাণ করে, ক্ষমতাসীন সরকার যখন প্রশাসনকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করে, তখন আমলারা নিজেদের দায়িত্ব ভুলে ক্ষমতাসীনদের স্তুতি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একজন পুলিশ প্রধানের কাজ হওয়া উচিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, কিন্তু জাবেদ পাটোয়ারী যখন শেখ মুজিবের আত্মজীবনী লেখার নামে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পান, তখন তা প্রমাণ করে যে, প্রশাসন কতটা রাজনীতির দাসত্ব করছে। এমনকি অভিযোগ আছে, এর তত্ত্বাবধান করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানÑযা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের চূড়ান্ত প্রমাণ।
রাষ্ট্রের শীর্ষ মহলে এরকম অনিয়ম প্রকাশ্যে আসার বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাবও আছে। মানুষ যখন দেখে পুলিশ প্রধান থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে সরকারি সুবিধা নিচ্ছেন, তখন প্রশাসনের প্রতি জনগণের বিশ্বাস নষ্ট হয়। অন্যদিকে, যোগ্যতার পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্যকে মূল্যায়ন করলে প্রশাসনে অদক্ষতা বাড়ে। ফলে জনসেবা ব্যাহত হয়। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, একবার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় অনিয়ম শুরু হলে, তা ক্রমশ ব্যাপক দুর্নীতিতে রূপ নেয়। ফ্ল্যাট, নগদ অর্থ আর পদোন্নতির বিনিময়ে রাজনৈতিক কাজ করার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে রাজনীতির দাসত্ব থেকে মুক্ত করা। এর জন্য প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানগত স্বাধীনতা। দুদক, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসনকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে হবে। পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিতে হবে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, রাজনৈতিক আনুগত্যে নয়। দুর্নীতির অভিযোগে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে অন্যরা উৎসাহিত না হয়।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ কেলেঙ্কারি শুধু একটি মামলা নয়; এটি একটি সতর্কবার্তা। যদি প্রশাসনকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তবে এমন কেলেঙ্কারি বারবার ঘটবে। জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব যারা নিয়েছিলেন, তারাই যদি সে ইতিহাসকে বিকৃত করে স্বার্থ হাসিল করেন, তবে তা জাতির জন্য চরম অপমান। এখনই সময় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির দাসত্ব থেকে মুক্ত করে নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে দাঁড় করানোর। নইলে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ হয়ে উঠবে অসমাপ্ত দুর্নীতির মূর্তপ্রতীক।