বসনিয়ার কথা কি মনে পড়ে? বসনিয়ার মানুষরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিলেন। বর্তমান সভ্যতার মুখোশ উন্মোচনে গাজা যুদ্ধের মতো বসনিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধও আমাদের পথ দেখাতে পারে। ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই সার্ববাহিনী বসনিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর সেব্রেনিৎসায় বসনীয়দের লক্ষ্য করে গণহত্যা শুরু করে। ২০ দিনের এ গণহত্যায় সেব্রেনিৎসার আট হাজারের বেশি বসনীয় মুসলিম পুরুষ ও ছেলে শিশুকে হত্যা করা হয়। এবার ১১ জুলাই সেব্রেনিৎসা গণহত্যার ৩০ বছর পূর্ণ হলো। এ উপলক্ষে সেব্রেনিৎসার কাছে পোতাচারি গ্রামে গণহত্যায় নিহতদের কবরস্থানে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বসনীয় নাগরিক ও বিদেশি প্রতিনিধিরা। তারা কবরস্থানে নিহতদের নাম খচিত স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া আপনজন হারানো বসনীয়রা তাদের প্রিয়জনদের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন।

সেব্রেনিৎসা গণহত্যার ৩০ বছর উপলক্ষে এক ভিডিও ভাষণে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান বলেন, সেব্রেনিৎসা গণহত্যাকে অস্বীকার করার সব ধরনের বক্তব্য তুরস্ক প্রত্যাখ্যান করে। এছাড়া তুরস্ক বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার ভূখণ্ডগত ঐক্য, সার্বভৌমত্ব ও সাংবিধানকি নীতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়। এরদোয়ান তার ভাষণে আরো বলেন, কয়েক দশক আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেব্রেনিৎসার গণহত্যায় যেভাবে চুপ ছিল, এখনো গাজার গণহত্যায় সেভাবে চুপ রয়েছে। তিনি বলেন, আজ হোক বা কাল, ইসরাইল সরকারকে গাজায় প্রায় ৫৮ হাজার ফিলিস্তিনিকে গণহত্যার দায়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা বর্তমান সভ্যতার শাসকরা যদি সেব্রেনিৎসা গণহত্যার ব্যাপারে সঙ্গত পদক্ষেপ নিতেন, তাহলে হয়তো গাজায় এমন নৃশংস গণহত্যা দেখতে হতো না। তারা মনে করেন, সেব্রেনিৎসা ও গাজায় গণহত্যার যে রূপ দেখা গেল, তাতে স্পষ্টভাবেই বলা চলেÑবর্তমান সভ্যতা বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট। উল্লেখ্য, গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ১১ জুলাইকে ‘আন্তর্জাতিক সেব্রেনিৎসা গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এসব পোশাকি তৎপরতায় নৃশংসতা কিন্তু হ্রাস পাচ্ছে না। এর কারণ, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষ থেকে তো সভ্যতার শাসকরা এখনো মুক্ত হতে পারেননি।

সেব্রেনিৎসা গণহত্যা দিবসের মত ইতিহাসের আর একটি কলঙ্কিত দিবস হলো ‘নাকাবা দিবস’। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনিদের তাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়নের নিষ্ঠুর কাজটি ব্যাপকভাবে শুরু হয়। বিপর্যয়ের সে ১৫ কে স্মরণ করতে প্রতিবছর পালিত হয় ‘নাকাবা দিবস’। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘নাকাবা দিবস’ পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ‘নাকাবা’ আরবি শব্দ। এর অর্থ দুর্যোগ। এর দ্বারা মূলত ১৯৪৮ সারের ১৫ মে ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে সংঘটিত যুদ্ধ ও সংঘর্ষে লাখ লাখ ফিলিস্তিনির গৃহহীন হওয়ার ঘটনাকে বোঝানো হয়। তাছাড়া ১৯৪৭-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর প্রভাব ফেলা ঘটনাবলীকেও বোঝানো হয়। এ সময় ১৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা যায়। তবে ‘নাকাবার’ বেশ আগেই ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল হীন চক্রান্ত। যারা সভ্যতার কথা বলেন, মানবতার কথা বলেন, বিশ্বশান্তির কথা বলেন, তারাই যদি ন্যায়ের মানদণ্ড পরিত্যাগ করে বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িক চেতনায় আগ্রাসী হয়ে ওঠেন, তখন তো জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। যার বড় উদাহরণ ফিলিস্তিন, আর এর মূলে ছিল ‘বেলফোর ঘোষণা’। ফিলিস্তিনিদের দুঃখের সাথে জড়িয়ে আছে এ ঘোষণা। ১৯১৭ সালের ২ নবেম্বর জারি করা ‘বেলফোর ঘোষণাপত্রটি’ ছিল বেশ সংক্ষিপ্ত। মাত্র ৬৭ শব্দের একটি ঘোষণা। কিন্তু এর কারণে যে সংঘাত শুরু হয়, তা বর্তমান বিশ্বের জন্য বড় সঙ্কট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ওই ঘোষণার শতবর্ষ পূর্ণ হলেও সঙ্কটের কোনো সুরাহা হয়নি। বরং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত এখনো মধ্যপ্রাচ্যের সবচাইতে বড় সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ অ্যাভি শ্লায়াম এ প্রসঙ্গে বলেন, বেলফোর ঘোষণায় বৃটিশ সরকারের জন্য গৌরবের কিছু নেই। এ ঘোষণা ছিল লজ্জাকর ও দুঃখজনক পদক্ষেপ। বৃটিশ সরকারের তাই লজ্জায় মাথা নত করা উচিত। এ ঘোষণায় আসলে কী রয়েছে? বেলফোর ঘোষণা ছিল ফিলিস্তিনে ‘ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠায় ১৯১৭ সালে যুক্তরাজ্যের করা একটি প্রতিশ্রুতি। তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর এক চিঠিতে বৃটিশ ইহুদি নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথস চাইলডকে ওই প্রতিশ্রুতি দেন। ফিলিস্তিন সে সময় অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ইহুদিরা সেখানে ছিল সংখ্যালঘু, মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ ছিল তারা। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) চলাকালীন সময়ে বেলফোর ঘোষণা আসে এবং অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর তা বাস্তবায়ন করা হবে বলে এতে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। তথাকথিত এ ম্যাণ্ডেট ব্যবস্থা মিত্রশক্তির দেশগুলো তৈরি করেছিল, যা ছিল আসলে ঔপনিবেশিকতা ও দখলদারিত্বের এক নোংরা রূপ। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া পরাজিত হওয়ার পর এ ম্যাণ্ডেটের বলে বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ মিত্রশক্তির কর্তৃত্বে আসে। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে বৃটিশ সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠা। এ লক্ষ্যের বাস্তবায়ন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বৃটিশ সরকার ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের ফিলিস্তিনে গিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দিতে থাকে। এর পরের ঘটনাতো সবার জানা। বেলফোর ঘোষণার কারণে ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনীরা আজ নিজ দেশেই অধিকার হারা। জুলুম-নির্যাতনের পাশাপাশি ক্রমাগতভাবে নিজ আবাসস্থল থেকে ফিলিস্তিনী নাগরিকদের উৎখাত করে যাচ্ছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। এমন অন্যায় কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের আরও কিছু রাষ্ট্র। এমন আসকারা পেয়ে গাজায় যুদ্ধাপরাধ অব্যাহত রেখেছে ইসরাইলী বাহিনী। গাজায় ইসরাইলী হামলায় প্রতিদিনই নিহত হচ্ছেন ফিলিস্তিনী নারী, পুরুষ ও শিশু। জাতিগত নিধনেরও পরিকল্পনা নিয়েছেন ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু। ফিলিস্তিনের গাজায় ২১ মাসের বেশি সময় ধরে টানা নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এ সময়ে উপত্যকাটিতে হামলা চালিয়ে ৫৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে ইসরাইলী বাহিনী। এরপরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন, আলোচনা চলছে, যুদ্ধবিরতির বিষয়ে অগ্রগতি হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এর চাইতে বড় প্রহসন আর কি হতে পারে। যুদ্ধবিরতি ও শান্তির বুলি আওড়াতে আওড়াতে তো ৫৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। ফিলিস্তিনীদের এক উদ্বাস্তু জাতিতে পরিণত করেছে বর্তমান সভ্যতা। মানবজাতির সামনে এমন নিকৃষ্ট সভ্যতা আর কখনো আসেনি।

নীতিভ্রষ্ট বর্তমান সভ্যতার শাসকরা নিজেদের মধ্যেও আস্থার সংকটে ভুগছেন। পাশ্চাত্য বলতে তো আমরা আগে ইউরোপ ও আমেরিকার মিলিত শক্তিকেই বুঝতাম। এখন সেখানেও ফাটল ধরেছে। ট্রাম্পের নীতি ও আচরণের কারণে ইউরোপ এখন নিজেদের আলাদা করে ভাবছে। নিজেদের প্রতিরক্ষা সামর্থ বাড়াতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের আহ্বান জানিয়েছেন ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও নতুন উদ্যোগ নেয়ার কথা বলছেন তাঁরা। পরাশক্তিতো আরও আছে। চীন ও রাশিয়ার কথাওতো তাঁদের ভাবতে হবে। এ কারণেই হয়তো ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখো বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের স্বাধীনতা এখন সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে রয়েছে। তাঁর মতে, গুরুত্বপূর্ণ এক সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ। এমন পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ কয়েকশত কোটি ইউরো বাড়ানো উচিত বলে তিনি মনে করেন। বাস্তিল দুর্গ পতন দিবসের একদিন আগে স্থানীয় সময় গত রোববার এসব কথা বলেন মাখোঁ। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গ পতনের মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। এর মধ্যদিয়ে দেশটিতে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। প্যারিস থেকে এএফপি পরিবেশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস্তিল দুর্গ পতন দিবস উপলক্ষে ফ্রান্সের সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে রাশিয়ার দিক থেকে হুমকির বিষয়টি উল্লেখ করে ‘সাম্রাজ্যবাদী নীতি’, ‘অন্যের ভূখণ্ড দখলকারী’ ও ‘বলপ্রয়োগই শক্তি’ নীতির নিন্দা জানান ফরাসি প্রেসিডেন্ট। এমন পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন মাখোঁ। গুরুত্বারোপের এ বিষয়টি সবার মাথায় এখন ভন ভন করে ঘুরছে। ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন শুধু নয়, আঞ্চলিক শক্তিগুলোও তাদের প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে বদ্ধপরিকর। তাহলে বিষয়টা এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো? ভ্রষ্ট বিশ্বব্যবস্থায় নীতিভ্রষ্ট শাসকরা কেউ কারো ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। কূটনীতির মুখোশ পরেই তাঁরা মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে গেলেন। মাখোঁও এপথে হাঁটার কথাই বললেন। আসলে শান্তির পথে কেউ নেই। যার অস্ত্র আছে, তিনিও শান্তিতে নেই; আর যার অস্ত্র নেই, তিনিও আছেন আতঙ্কে। অথচ মহান স্রষ্টা মানববান্ধব করেই শান্তিময় এ পৃথিবীটা সৃষ্টি করেছিলেন। বসনিয়া এবং ফিলিস্তিনতো শান্তিময় পৃথিবীরই অংশ ছিল। যারা সেখানে অশান্তি সৃষ্টি করবেন, তাঁরা শান্তিতে থাকবেন কেমন করে? পৃথিবীতো একটাই।