সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে অভিযান চলছে, তা একান্তভাবে প্রশংসার দাবি রাখে। দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী তৎপরতা কিছুটা স্তিমিত থাকলেও, হঠাৎ করেই নানা গোয়েন্দা তথ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, কিছু সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। তারা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং নাগরিক জীবনের স্বাভাবিক গতি বিঘিœত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এমন প্রেক্ষাপটে, সন্ত্রাসীদের আটক ও প্রতিরোধে পরিচালিত অভিযান শুধু সময়োপযোগী নয়, বরং জাতীয় স্বার্থে অপরিহার্য।

এরই মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সেনা অভিযানে শীর্ষসন্ত্রাসী ফরিদ আহমেদ বাবু ওরফে এক্সেল বাবুসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে সেনাবাহিনীর অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। অন্যদিকে তালিকাভুক্ত শীর্ষসন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তারের পর তাঁদের দেওয়া তথ্যমতে ঢাকার হাতিরঝিল থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা হলেন সুব্রত বাইনের সহযোগী শুটার আরাফাত ও শরিফ। এ ধরনের অভিযানের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে।

মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাস নিছক কোন অপরাধ নয় বরং এটি একটি সংগঠিত সহিংস অপতৎপরতা, যার লক্ষ্য হচ্ছে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে নিজেদের দখলদারি বা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। কোনো রাজনৈতিক বা আদর্শিক মোড়কে এসব অপতৎপরতা ঢেকে ফেলা হলেও, প্রকৃতপক্ষে এগুলো নিছক ক্ষমতা, প্রতিশোধ এবং ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ারই প্রয়াস। তাই, এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা জরুরি।

যে পদ্ধতিতে সম্প্রতি অভিযান পরিচালিত হচ্ছেÑতা উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে টার্গেট নির্ধারণ করে সুনির্দিষ্ট এলাকায় অভিযান চালানো এবং সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করার কৌশল অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ করে কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর থেকে সুব্রত বাইনকে গ্রেফতারের ঘটনা সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়েছে। আটক করার সময় অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্র, বিস্ফোরক, যোগাযোগ সরঞ্জাম, স্যাটেলাইট ফোন ও নগদ অর্থসহ আটক সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, যা পরবর্তী অভিযানের জন্য সহায়ক। একজন সন্ত্রাসীকে আটকের পর তার লিংক থেকে গ্রুপের অন্যান্য সন্ত্রাসীদের আটক করা হচ্ছে। এমন পদ্ধতিগত ও তথ্যভিত্তিক অভিযান চলমান থাকলে, সন্ত্রাসীদের শিকড় উপড়ে ফেলা সম্ভব।

তবে শুধু মাঠ পর্যায়ের অভিযান যথেষ্ট নয়। সন্ত্রাসবিরোধী এ লড়াইয়ে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করতে হবে। আটককৃতদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, সন্ত্রাসীদের অর্থায়নকারী ও পৃষ্ঠপোষকদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা এবং সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের প্রযুক্তিগত যোগাযোগব্যবস্থাকে চিহ্নিত করে তা ভেঙে ফেলা-এ তিনটি দিকেও নজর দিতে হবে। দেশের ভেতরে যারা নানা অবৈধ পন্থায় এসব সন্ত্রাসীদের সহায়তা করে চলেছে, তাদের চিহ্নিত না করতে পারলে কেবল মাঠপর্যায়ের সন্ত্রাসী ধরা হলেও সমস্যা পুরোপুরি নির্মূল হবে না।

এছাড়া, সমাজে সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয়দানের যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আবহ তৈরি হয়, তা ভাঙতেও সরকার ও সমাজের সব অংশীজনদের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তরুণদের বিপথগামী হওয়ার পেছনে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, হতাশা, বৈষম্য এবং সহিংস পরিবেশের ভূমিকা থাকে। এসব কারণে অনেকেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে। তাই পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর উচিত হবে সচেতনতা তৈরিতে আরও সক্রিয় হওয়া। ধর্মীয় মোটিভেশন চালানো অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের প্রচারণা রুখে দিতে হবে কড়া নজরদারির মাধ্যমে।

একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কখনোই সন্ত্রাস ও সহিংস রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিতে পারে না। ইতিমধ্যেই আমরা অতীতে সন্ত্রাসের ভয়াবহতা দেখেছি। আওয়ামী আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা সন্ত্রাসের বিস্তার দেখেছি। আমরা সে সময়ে ফিরে যেতে চাই না। তাই বর্তমান অভিযানকে শুধু তাৎক্ষণিক উত্তরের চেয়ে একটি ধারাবাহিক, গভীর ও কৌশলগত উদ্যোগে পরিণত করতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, বিচার বিভাগ এবং জনগণÑসকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনো আপস নয়Ñএই মর্মে রাষ্ট্রকে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি রাষ্ট্র তখনই নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ হয়, যখন সেখানে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার এবং অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান থাকে। আমরা আশা করি, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং বাংলাদেশ একটি নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবেই তার পথচলা ধরে রাখবে।