বর্তমান সভ্যতায় আমরা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কথা শুনি, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তর্ক দেখি, আর কূটনীতির ধূম্রজাল তো লক্ষ্য করার মতো। তবে সততা, সরলতার আলাপ কম হয়। অথচ এ বিষয়গুলোর ওপর নির্ভরশীল কাক্সিক্ষত মানবিক সমাজ ও সভ্যতা। আমরা তো দশকের পর দশক ধরে বর্তমান বস্তুবাদী সভ্যতার চালচিত্র দেখে আসছি। সভ্যতার রঙ ‘লাল’ বা ‘ধবল’ যেটাই হোক না কেন, তাতে কোনো তারতম্য ঘটেনি। শোষণ ও বঞ্চনার ধারা অব্যাহত রয়েছে। সততা ও সরলতার ধারা সমাজ থেকে অপসৃত হলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, তখন সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্ব বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বর্তমান সময়টা কি তার স্পষ্ট উদাহরণ নয়? অবশ্য সততা ও সরলতার বিষয়টি মানুষের জীবনদর্শনের সাথে জড়িত। মানুষ যদি সেকুলার তথা ইহলৌকিকবাদী হয়ে সংকীর্ণ হয়ে পড়ে, তখনতো দুনিয়ার স্বার্থটাই তার কাছে বড় হয়ে উঠবে। সুখময় জীবন-যাপনের জন্য যে কোনোভাবে অর্থ-সম্পদ অর্জন তার কাছে মুখ্য হয়ে উঠবে। সেটা সমাজতন্ত্রের নামে হতে পারে, হতে পারে পুঁজিবাদের নামেও। বাস্তব দুনিয়ায় তো এসব তত্ত্বকে একাকার হয়ে যেতে দেখেছি আমরা। পোশাকি তারতম্যের রকমফেরও আমরা লক্ষ্য করেছি। আসলে সততা ও সরলতার গভীরতর উপলব্ধির অবর্তমানে তো চাতুর্য ও শঠতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পাবে। তেমন এক অমানবিক সভ্যতায় এখন আমাদের বসবাস। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সততা ও সরলতা- সমৃদ্ধ জীবনের জন্য প্রয়োজন স্রষ্টায় বিশ্বাস। স্রষ্টায় বিশ্বাস করলে কৃতকর্মের জন্য পরকালের বিচার ব্যবস্থায়ও বিশ্বাস করতে হবে আমাদের। এমন বিশ্বাসই চাতুর্য ও শঠতার বদলে মানুষকে সৎ ও সরল হতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। চাতুর্য ও শঠতাপুষ্ট মানুষও জ্ঞানী হতে পারে, তার্কিক হতে পারে, কিন্তু তাদের দিয়ে কাক্সিক্ষত মানবিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ পরিগঠন সম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা তার বড় প্রামাণ।

স্রষ্টা ও পরকালে বিশ্বাসী মানুষ বস্তুবাদী বর্তমান সভ্যতায় ও সততা-সরলতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম। কুমিল্লার ব্যাটারি চালিত অটোরিকশাচালক অনিক হাসান তেমন এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাঁর অটোরিকশায় ১৫ লাখ টাকা পেয়ে তা যাত্রীকে খুঁজে ফেরত দিয়েছেন। আর সততার এমন কাজে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তাঁর বাবা। গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লা শহরে এ ঘটনা ঘটে। অনিক হাসানের (২৫) বাড়ি কুমিল্লা শহরের চৌধুরীপাড়া এলাকায়। অভাবের সংসার তাঁদের। তাঁর বাবা মো. আব্দুস সালামও অটোরিকশা চালান। ঘটনা প্রসঙ্গে হাসান বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল আটটার দিকে শহরের পানপট্টি এলাকা থেকে মেয়েকে নিয়ে এক ব্যক্তি তাঁর অটোরিকশায় উঠেছিলেন। তিনি মেয়েকে নিয়ে শহরের বজ্রপুর এলাকার একটি কিণ্ডারগার্টেনে গিয়েছিলেন। তিনি ভুল করে আমার গাড়িতে টাকা ফেলে যান। যাত্রীকে নামিয়ে তিনি একটি চায়ের দোকানে বসেন। হঠাৎ চোখে পড়ে গাড়ির ভেতরে নীল রঙের একটি পলিথিন ব্যাগ। ব্যাগ খুললে তাতে দেখতে পান অনেক টাকা। প্রথমেই কল দেই বাবাকে। বাবা বলেন, ‘যার জিনিস, তারে খুঁজে দিয়ে আয়। অন্যের টাকা নিয়ে বাঁচতে নেই। হাসান বলেন, বাবার কথামতো তিনি অটোরিকশা নিয়ে সে স্কুলের সামনে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে সে যাত্রীকে পাননি। কয়েকবার সে জায়গায় গিয়ে একপর্যায়ে সকাল পৌণে নয়টার দিকে টাকার মালিককে খুঁজে পান। টাকার মালিক মরণ সূত্রধর একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী। তিনি ভেবেছিলেন ওই টাকা আর পাবেন না। টাকা পেয়ে মরণ সূত্রধর হাসানকে অনেক আশীর্বাদ করেন। খুশি হয়ে তিনি হাসানকে কিছু টাকা উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হাসান কিছুতেই তা গ্রহণ করেননি। এলাকার লোকজন বলছেন, এ ঘটনা সততার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

কুমিল্লার ঘটনায় রয়েছে অনেক বার্তা। বিশ্বাসীদের পরকাল ভাবনা তাঁদের কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে, এখানে দারিদ্র্য কোনো বাধা হতে পারে না। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মূল্যবোধের সঠিক চর্চা যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হতে পারে। এখানে আর একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, সততাবিহীন সেকুল্যার পণ্ডিতদের চাইতে একজন বিশ্বাসী অটোরিকশা চালক অনেক মহৎ মানুষ হতে পারেন। কুমিল্লার ঘটনা আমাদের অনেকের চোখ খুলে দিতে সমর্থ হবে বলে আশা করি।