‘নিরাপদ খাদ্য আইনে তিন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা’ শীর্ষক একটি খবর সম্প্রতি দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ৭ মার্চ কিশোরগঞ্জের বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ১ম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে নিরাপদ খাদ্য আইনে সংক্ষিপ্ত বিচারিক প্রক্রিয়ার (সামারি ট্রায়াল) মাধ্যমে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত পরিচালনা করা হয়। সংশ্লিষ্ট আদালতের মাধ্যমে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত রাদিত সামিয়া ফুড প্রোডাক্টসকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য প্রস্তুত ও বাধ্যতামূলক নিবন্ধন ব্যতীত খাদ্য উৎপাদনের দায়ে ০২ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, গাংচিল রেস্তোরাকে লেবেল বিহীন খাদ্য উৎপাদন ও বিক্রি এবং পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের রশিদ সংরক্ষণ না করার দায়ে ০১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড, গৌর গোবিন্দ সুইটস কেবিনকে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অনুনোমোদিত রং ব্যবহার ও পন্য ক্রয়-বিক্রয়ের রশিদ সংরক্ষণ না করার দায়ে ০১ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড করা হয়।

খাদ্য জীবন বাঁচায়, জীবনের এক অনুষঙ্গ। তাই খাদ্য নিরাপদ হওয়া দরকার। কেননা অনিরাপদ খাদ্য মানুষের রোগব্যাধি ও মৃত্যুর কারণ হতে পারে। নানাভাবে খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর উপকরণ ব্যবহৃত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার বিক্রি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ এ খাবার গ্রহণ করে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। মানুষের সুস্থ জীবনের জন্য নিরাপদ খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বলছে, খাদ্যনিরাপত্তার চারটি ‘পিলার’ বা স্তম্ভ আছে। এগুলো হলো সহজলভ্যতা, প্রবেশাধিকার, উপযোগিতা ও স্থিতিশীলতা। বাংলাদেশে শুধু নয়, সারা বিশ্বে নিরাপদ খাদ্য ভোক্তার অধিকার হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে সংবিধান অনুযায়ী মানুষের জীবনধারণের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো খাদ্য। বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা সাংবিধানিকভাবে মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত না হলেও রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত। জনস্বাস্থ্য ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানে ব্রিটিশ আমল থেকে অনেক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ২৭২ ধারা অনুযায়ী বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে দূষিত খাবার ও পানীয় বিক্রি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ধারা ২৫(গ) অনুসারে খাদ্যে ভেজালকে মৃত্যুদণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনিরাপদ খাদ্য বা ভেজাল খাদ্যের বিষয়টি ‘ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্যক্রম’ হিসেবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ আইনে খাদ্যপণ্যে ভেজাল মিশ্রণ একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কারাদণ্ড ও জরিমানা আরোপের বিধান করা হয়েছে।

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালে বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছে। এ আইনের ২ ধারা অনুযায়ী ‘নিরাপদ খাদ্য’ বলতে প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত আহার্য বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া বিএসটিআই আইন ২০১৮ এবং আয়োডিনযুক্ত লবণ আইন ২০২১ নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানে আইনি কাঠামোর অংশ।

এ আইনে নিরাপদ খাদ্যব্যবস্থা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিধিনিষেধের উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিষাক্ত দ্রব্যের ব্যবহার পরিহার; তেজস্ক্রিয়, ভারী ধাতু ইত্যাদির মাত্রাতারিক্ত ব্যবহার রোধ; ভেজাল খাদ্য বা খাদ্যোপকরণ উৎপাদন, আমদানি, বিপণন ইত্যাদি পরিহার; নিম্নমানের খাদ্য উৎপাদন না করা; খাদ্য সংযোজন দ্রব্য বা প্রক্রিয়াকরণ-সহায়ক দ্রব্যের ব্যবহার না করা; শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত তেল, বর্জ্য, ভেজাল বা দূষণকারী দ্রব্য ইত্যাদি খাদ্য স্থাপনায় না রাখা; মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ না রাখা; বৃদ্ধি প্রবর্ধক, কীটনাশক, বালাইনাশক বা ওষুধের অবশিষ্টাংশ, অণুজীব, ইত্যাদির ব্যবহার পরিহার; বংশগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনকৃত খাদ্য, জৈব খাদ্য, ব্যবহারিক খাদ্য, স্বত্বাধিকারী খাদ্য ইত্যাদি সরবরাহ বা বিক্রয় না করা; খাদ্য মোড়কীকরণ ও লেবেলিং পরিবর্তন না করা; মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত প্রক্রিয়ায় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদি পরিহার; রোগাক্রান্ত বা পচা মৎস্য, মাংস, দুগ্ধ বিক্রয় না করা; হোটেল রেস্তোরাঁ বা ভোজনস্থলের পরিবেশনসেবা দ্বারা ভোক্তার স্বাস্থ্যহানি না ঘটানো; ছোঁয়াচে ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত না করা; নকল খাদ্য উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদি পরিহার; অনিবন্ধিত অবস্থায় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, বিক্রয় না করা; কর্তৃপক্ষ বা তদকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সহযোগিতা করা প্রভৃতি।

কিশোরগঞ্জের অভিযানের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য প্রস্তুত, লেবেলবিহীন খাদ্য উৎপাদন ও বিক্রি, মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অনুনোমোদিত রং ব্যবহার করায় তিনটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। যে অভিযোগগুলো করা হয়েছে তা নিরাপদ খাদ্য আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য। আমরা মনে করি এ ধরনের অভিযান সব স্থানে ও ঘন ঘন হওয়া উচিৎ। খাদ্যের বিষয়ে কোন ছাড় দেয়ার উপায় নেই।