এবারের ঈদুল আজহা-বাংলাদেশের মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসবÑসাধারণ মানুষের জন্য বয়ে এনেছে এক ব্যতিক্রমধর্মী স্বস্তি ও শৃঙ্খলার বার্তা। বিগত বছরগুলোতে আমরা ঈদ উৎসবকে ঘিরে নানা ধরনের দুর্ভোগ, অনিয়ম, নিরাপত্তা সংকট এবং ভোগান্তির যে চিত্র দেখে এসেছি, এ বছর তা অনেকটাই অনুপস্থিত ছিল। ঈদের পশুর হাটে ছিল দাম ও সরবরাহে ভারসাম্য, যাত্রাপথে ছিল নির্বিঘ্ন চলাচল এবং আন্তর্জাতিকভাবে হজ্জ পালনের ক্ষেত্রেও কোনো উল্লেখযোগ্য হয়রানির খবর পাওয়া যায়নি। ঈদের এ সার্বিক ইতিবাচক অভিজ্ঞতার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুসংহত পরিকল্পনা ও কঠোর বাস্তবায়ন প্রশংসার দাবিদার।
বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহর থেকে মানুষ যেভাবে এবারে সড়ক, রেল ও নৌপথে নির্বিঘ্নে নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছেছে, তা নিকট অতীতের সঙ্গে তুলনা করলে একটি সুস্পষ্ট ব্যবস্থাপনাগত অগ্রগতি প্রতিফলিত হয়। যেখানে আগে ঈদের আগে-পরে মহাসড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট, যাত্রীদের হয়রানি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ট্রেন ও লঞ্চের বিলম্ব যেন ঈদের একটি অনিবার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিলÑসেখানে এবার দৃশ্যপট অনেকটাই ভিন্ন ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, রেলওয়ে প্রশাসন এবং বিআইডব্লিউটিএ সকলে মিলে সমন্বিত যে নজরদারি চালিয়েছে, তাতে ঈদযাত্রা অনেকটাই শৃঙ্খলিত হয়েছে। এ সমন্বয়ের কৃতিত্ব সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে অবশ্যই দেওয়া উচিত।
অন্যদিকে কুরবানির পশুর বাজারের দিকেও এবার জনসাধারণের মধ্যে ছিল একটি সন্তোষজনক প্রতিক্রিয়া। আগের বছরগুলোতে পশুর অপ্রতুলতা, কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ, অতিরিক্ত দাম, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং শহরে পশু পরিবহনে বিশৃঙ্খলা ছিল সাধারণ ঘটনা। তবে এবারে সরকার সময়মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক পশু হাটে তুলতে পেরেছে এবং ডিজিটাল হাট ব্যবস্থাপনার প্রসার ঘটিয়ে একাধিক উৎস থেকে পশু সংগ্রহ নিশ্চিত করেছে। ফলে বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বজায় ছিল, দাম ছিল তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল এবং অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবার কুরবানির সুযোগ পেয়েছে। পশু পরিবহনে সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা ও অবৈধ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে বিভিন্ন এলাকায় পশুর হাটের বাইরে ছোট ছোট যে পশুগুলো বিক্রি হয়েছে সেগুলোর হাসিল দেয়ার নজির না থাকলেও স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের জোরপূর্বক চাঁদা আদায়ের কিছু ঘটনাও এবার ঘটেছে যা নজিরবিহীন।
শুধু দেশের ভেতর নয়, আন্তর্জাতিকভাবে হজ্ব পালনের ক্ষেত্রেও এবারে বাংলাদেশিদের অভিজ্ঞতা ছিল তুলনামূলকভাবে স্বস্তিদায়ক। হজযাত্রীরা নির্ধারিত সময়েই সৌদি আরবে পৌঁছাতে পেরেছেন, হজ ক্যাম্প ও বিমানবন্দরে ছিল শৃঙ্খলা এবং সৌদি আরবে বাংলাদেশের হজ মিশনের কার্যক্রমও ছিল যথাযথভাবে পরিচালিত। আগে যেসব অভিযোগ শোনা যেতÑযেমন, হজ ফ্লাইট বাতিল, যাত্রীদের অনিরাপদ অবস্থান, শেষ মুহূর্তে ফ্লাইটে উঠতে না পেরে হাজীদের কান্না- এবার সেগুলো অনুপস্থিত ছিল। সৌদি সরকারের সঙ্গে সমন্বয়, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং হজযাত্রীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখার ফলে হজ ব্যবস্থাপনা পেয়েছে এক নতুন মাত্রা।
এবারের ঈদ এবং হজ ব্যবস্থাপনার সার্বিক সফলতা আমাদের একটি বড় বার্তা দেয়Ñযদি আন্তরিকতা, সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে জনগণকে ভোগান্তিমুক্ত রাখা সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল সংবেদনশীল; একদিকে নির্বাচনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জনআস্থার সংকট, অন্যদিকে একটি বড় ধর্মীয় উৎসব ঘিরে সরকারের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা। সে প্রেক্ষাপটে সরকার যেভাবে দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে ঈদের ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বজায় রেখেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।
তবে এটিই যেন শেষ নয়। এবারের সফলতাকে একটি স্থায়ী রূপ দিতে হলে এ ধরনের আন্তরিকতা ও সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যতের সব জাতীয় কর্মসূচিতে বজায় রাখতে হবে। কোরবানির পশু পরিবহন, ডিজিটাল হাট ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, রেল-নৌ পরিবহন সময়ানুবর্তিতা এবং হজ ব্যবস্থাপনায় প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। ঈদের সময় যে ‘স্বস্তির বাংলাদেশ’ আমরা দেখেছি, তা যেন শুধু সাময়িক স্বস্তি হয়ে না থাকে, বরং সার্বিক ব্যবস্থাপনায় একটি টেকসই রূপ নেয়-এ হোক সকলের প্রত্যাশা। এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের কাছে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি।