চলতি অর্থবছরের (২০২৫-২০২৬) প্রথম মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২৯ শতাংশ। গত জুলাই মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ২শ’ ৪৭ কোটি মার্কিন ডলার। আগের বছর জুলাই মাসে প্রবাসী আয়ে এসেছিল ১শ’ ৯১ কোটি মার্কিন ডলার। প্রবাসী আয় বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উপর চাপ হ্রাস পেয়েছে। মুদ্রাবাজার মার্কিন ডলারের উপর চাপ কমেছে। এমনকি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার কমে যাবার আশঙ্কা দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো কোনো সময় বাজার থেকে কিছু মার্কিন ডলার কিনে নিচ্ছে। প্রবাসী আয় বৃদ্ধির এ ধারা সৃষ্টি হয়েছে গত অর্থবছর থেকে যখন মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ক্রমান্বয়ে বাজারভিত্তিক করার উদ্যোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিগত সরকার আমলে অনেক দিন পর্যন্ত প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকা নির্ধারণ করে রেখেছিল। সরকার সমর্থক কতিপয় উদ্যোক্তাগোষ্ঠীকে সস্তা মূল্যে ডলার সরবরাহের লক্ষ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকায় নির্ধারণ করে রাখে। তখন কার্ব মার্কেটে প্রতি মার্কিন ডলার ১২০ থেকে ১২৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্থানীয় মুদ্রায় বেশি অর্থ পাবার প্রত্যাশায় হুন্ডির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাতে থাকে। পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এতে করে মাত্র একদিনের ব্যবধানে প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ১১৭ টাকায় উন্নীত হয়। পরবর্তীতে ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজার ভিত্তিক করে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা করেছিলেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা হলে মুদ্রা বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দেবে এবং স্থানীয় মুদ্রা টাকার ব্যাংক ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটবে। কিন্তু তাদের সে আশঙ্কা সত্যি হয়নি। মুদ্রার বাজারে বর্তমানে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১১০ টাকায় ফিক্সড করে রাখার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজার ভিত্তিক করার উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ব্যাংকিং চ্যানেল ও কার্ব মার্কেটে মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের ব্যবধান যৌক্তিকভাবে কমে আসে। ব্যাংকিং চ্যানেল এবং কার্ব মার্কেটে মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের মধ্যে প্রায় সমতা সৃষ্টি হওয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা হুন্ডির মাধ্যমে তাদের উপার্জিত অর্থ দেশে প্রেরণ না করে বৈধ পথে প্রবাসী দেশে প্রেরণ করতে থাকে। এছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সমর্থন পুষ্ট হুন্ডি ব্যবসায়িদের তৎপরতা অনেকটাই কমে গেছে।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোট ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে প্রেরণ করেছে। এর আগে আর কখনোই এত বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয় দেশে আসেনি। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিযন মার্কিন ডলার। প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি খাত। এখনো পণ্য রপ্তানি খাত থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। তবে পণ্য রপ্তানি খাত থেকে যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তার একটি বড় অংশই কাঁচামাল আমদানি ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিতে পুনবায় বিদেশে চলে যায়। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে এ সেক্টরের মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানি খাত থেকে যে অর্থ আয় আয় হয় তার প্রায় পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করছে। এছাড়া এ খাতে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় কিন্তু অবহেলিত খাত হচ্ছে জনশক্তি খাত। এ খাত এখনো ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে বিধান নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি এ খাতের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি বিকশিত হতে দিচ্ছে না।
বাংলাদেশে থেকে প্রতি বছরে যে বিপুল সংখ্যক জনশক্তি বিদেশে প্রেরণ করা হয় তার সিংহভাগই অদক্ষ এবং অপ্রশিক্ষিত। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩ মোতাবেক, বাংলাদেশ থেকে যে জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি করা হয় তার মধ্যে ৭৩ দশমিক ৬৯ শতাংশই স্বল্প দক্ষ(আসলে অদক্ষ),আধা দক্ষ ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ, দক্ষ ২২দশমিক ২২ শতাংশ। পেশাজীবীর হার ছিল মাত্র শুন্য দশমিক ৩২ শতাংশ। আমরা যদি পরিকল্পিতভাবে পেশাজীবী এবং প্রশিক্ষিত জনশক্তি রপ্তানি করতে পারতাম তাহলে এই খাতের আয় অনেকগুন বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিল। প্রতিযোগি অনেক দেশ পেশাজীবী এবং দক্ষ জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি করে আমাদের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ আয় করছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।