বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এত উন্নতির পরও মানবজাতির দুর্ভাগ্য হলো, বিবিধ দূষণের মধ্যেই এখনো তাদের বসবাস। জলবায়ু দূষণ নিয়ে কথা হয়, খাদ্য দূষণ নিয়ে কথা হয়, কিন্তু প্রচারণা-দূষণ নিয়ে তেমন কথা হয় না। অথচ এ অঙ্গনে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে এবং তা বহুমাত্রিকও বটে। ইন্টারনেটের বদৌলতে এখন হরেকরকম মিডিয়ার আবির্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার যা ইচ্ছে প্রচার করছে। নীতি-নৈতিকতা, বস্তুনিষ্ঠতার মত বিষয়গুলো মানুষ হয়তো ভুলতে বসেছে। এ জন্যই বোধ হয় বিজ্ঞজনরা বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষা-সিলেবাসে ‘ইন্টারনেট ইথিক্স’ নামক একটি বিষয় যুক্ত করেছেন। পাশ্চাত্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও বিষয়টি পড়ানো হচ্ছে এবং তা বেশ আগে থেকেই। আমাদের দেশেও স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘ইন্টারনেট ইথিক্স’ এর পঠন-পাঠন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, ইন্টারনেটের অনৈতিক ব্যবহার পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রে মন্দ প্রভাব ফেলছে।
আসলে সব দেশের জন্যই ‘ইন্টারনেট ইথিক্স’-এর পঠন-পাঠন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা প্রতিবেশি দেশ ভারতে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার লক্ষ্য করেছি। ইন্টারনেট, এমনকি মূল ধারার গণমাধ্যমও কতটা দায়িত্বহীন ও উদ্দেশ্যপ্রবণ হতে পারে সে নজির আমরা দেখেছি। এখন আবার বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভারতীয় মিডিয়া ও ইন্টারনেটের অপপ্রচার। উল্লেখ্য, ভারতের একটি হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে মৃতদেহ টেনে তোলার ভিডিওকে ‘জামায়াত নেতার নির্দেশে খুন’ করা হয়েছে দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে। বিষয়টি মিথ্যা বলে শনাক্ত করেছে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর ফ্যাক্ট চেক ও মিডিয়া রিসার্চ টিম বাংলাফ্যাক্ট।
বাংলাফ্যাক্ট জানায়, ‘জামায়াত নেতার নির্দেশে খুন’ বলে চালানো ভিডিওটি কার্যত ভারতের অন্য ঘটনার। জামায়াত নেতার কথামতো ফাইলে স্বাক্ষর করেনি বলে ‘একজন সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যা করে অমানবিকভাবে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে তোলার দৃশ্য’ হিসেবে দাবি করা একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, দুই ব্যক্তি একটি ভবনের সিঁড়ি দিয়ে উলঙ্গ একজনের দেহ উল্টো করে টেনে তুলছেন। বাংলাফ্যাক্ট যাচাই করে দেখেছে, এ ভিডিওটি বাংলাদেশের কোনো ঘটনার নয়। প্রকৃতপক্ষে চলতি বছরের ১১ আগস্ট ভারতের বিহারের পশ্চিম চম্পারণ জেলার বেত্তিয়া শহরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের (জিএমসিএইচ) সিঁড়িতে এক ব্যক্তির মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় তা ক্যামেরায় ধরা পড়ে। এটি সে ঘটনার দৃশ্য। মিথ্যাচার আর অপপ্রচারের এমন চিত্র আমাদের কী বার্তা দেয়?
কোথায় ভারতের বিহারের বেত্তিয়া শহর, আর কোথায় বাংলাদেশ! কোথায় হাসপাতালের সিঁড়িতে এক ব্যক্তির মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, আর কোথায় জামায়াত নেতার নির্দেশে খুন! এমন অপপ্রচার ভারতের মত একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশে চলে কেমন করে? জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে এমন অপপ্রচার দেখে উপলব্ধি করা যায়, দেশটিতে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা কতটা প্রবল। ভারতের প্রতিষ্ঠাতারা তো ‘বৈচিত্র্যের ঐক্যের’ কথা বলেছিলেন, কিন্তু আলোচ্য ঘটনায় তো তার বিপরীত মানসিকতাই লক্ষ্য করা গেলো। ঘটনা যেখানেই হোক, যে কোনোভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের দুর্নাম করতে পারলেই যেন ভারতের একশ্রেণীর মানুষের, বিশেষ করে বিজেপি ঘরানার লোকদের রাজনীতির ষোলকলা পূর্ণ হয়। এমন কর্মকাণ্ড আসলে মানবসমাজে চলতে পারে না। ভারত কি নিজেকে মানব সমাজের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না? অন্তর্ভুক্ত মনে করলে ‘ইন্টারনেট ইথিক্স’সহ অন্যান্য ইথিক্সের আলোকে নিজেকে সংশোধন করাই এখন দেশটির জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।