সম্পাদকীয়
বন অধিদপ্তরে দুদকের অভিযান প্রসঙ্গে
বন অধিদপ্তরে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা নতুন কিছু নয়। অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারি দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের অর্থবিত্ত বাড়িয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিগত ১/১১-এর জরুরি সরকারের আমলে বন
বন অধিদপ্তরে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা নতুন কিছু নয়। অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারি দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের অর্থবিত্ত বাড়িয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিগত ১/১১-এর জরুরি সরকারের আমলে বন বিভাগের একজন শীর্ষকর্তা ‘বনখেকো ওসমান’ নামে আখ্যা পেয়েছিলেন এবং তিনি দণ্ডিতও হয়েছেন। সে সময়ে তিনি এবং তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক তদন্ত হলেও বন বিভাগের দুর্নীতি কমেনি বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেয়েছে। বন অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগের প্রেক্ষিতেই সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। সম্প্রতি দুদক অধিদপ্তরে দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে বিশেষ অভিযান চালিয়েছে। এতে অধিদপ্তরে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ ও ঘুষ লেনদেনসহ নানা অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির অভিযানের পর জমা দেয়া প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) জানিয়েছেন, দুদক এনফোর্সমেন্ট ইউনিট ২৪ ফেব্রুয়ারি বনভবনে অভিযান পরিচালনা করে। এরপরই কমিশন বরাবর এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় অভিযান পরিচালনাকারী দল।
দুদকের এ অভিযান পরিচালনা করেন সহকারী পরিচালক মো. ইসমাঈলের নেতৃত্বাধীন এনফোর্সমেন্ট টিম। এ সময় প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসাইন চৌধুরী, উপপ্রধান বন সংরক্ষক এবং টেকসই বন ও জীবিক (সুফল) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক গোবিন্দ রায়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়।
এনফোর্সমেন্ট টিমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসাইন চৌধুরীর অধীনে প্রশাসনিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব রয়েছে। বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার অভাবে গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার দপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয়িত অর্থের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়; তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের বিষয়ে তিনি কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বলে জানা গেছে।
এতে আরও বলা হয়, আমির হোসাইন চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে। নির্ধারিত নীতিমালা উপেক্ষা করে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি ও নিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। দপ্তরের প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম এতটাই প্রকট যে, বনবিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতার সংকট দেখা দিয়েছে। বদলি ও পদায়ন নীতিমালার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির বিস্তারের ফলে বন অধিদপ্তরের প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
প্রাথমিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলি ও পদোন্নতি ‘বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলি সংক্রান্ত নীতিমালা, ২০০৪’ অনুসারে হওয়ার কথা থাকলেও, এটি অনুসরণ করা হয়নি। বিভিন্ন বনবিভাগের রেঞ্জ ও স্টেশন পোস্টিংয়ে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বদলি ও পদায়নের তথ্য পাওয়া গেছে, যেখানে প্রধান বন সংরক্ষকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে সরজমিন অনুসন্ধানে। এ ছাড়াও, টেকসই বন প্রকল্পের অধীনে গত দুই অর্থবছরে ৮৭২ হেক্টর নার্সারি ও বনায়ন করার পরিকল্পনা থাকলেও, তদন্তে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য অংশে কোনো বনায়ন করা হয়নি। কিছু এলাকায় শুধু সীমানা নির্ধারণের জন্য সামান্য চারা লাগানো হয়েছে। যা বড় ধরনের অনিয়ম বলেই বিবেচিত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা বিট এলাকায় ৫১০ হেক্টর বনভূমিতে নতুন বাগান সৃজনের বরাদ্দ থাকলেও, বাস্তবে মাত্র ১৬০ হেক্টরে বনায়ন হয়েছে। একইভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৩৬২ হেক্টর বনায়ন প্রকল্পেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব প্রকল্পে অর্থের অপচয় ও আত্মসাতের ক্ষেত্রে প্রধান বন সংরক্ষকের অসহযোগিতা ও নজরদারির অভাব সুস্পষ্ট।
এনফোর্সমেন্ট টিম আরও জানতে পারে, অধিকাংশ এলাকায় চারা রোপণের নামে বরাদ্দ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। যেখানে গাছের অস্তিত্ব নেই, সেখানে সরকারি সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে। পরিচর্যার অভাবে রোপিত চারাগুলোর বেশির ভাগই মারা গেছে। এ অভিযানের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে কমিশন পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম। কিন্তু অতীত পর্যালোচনায় খুব একটা আশাবাদী হওয়ার সুযোগ থাকছে না। কারণ, কোন অনিয়মের বিরুদ্ধে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে মাঝপথে তা থেমে যাওয়ার অতীত রেকর্ডও রয়েছে। মূলত, প্রভাবশালীরা এসব কাজে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। তাই আমরা আশা করছি দুর্নীতিবাজ ও স্বেচ্ছাচারি বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের বিরুদ্ধে দুদক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটি কোন শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হবে না।
রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাট একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুপস্থিতি এবং সকল ক্ষেত্রে জবাবদিহীতার অভাব এর উল্লেখযোগ্য কারণ। আর সে ধারাবাহিকতায় বন বিভাগের লাগামহীন দুর্নীতি ও হরিলুটের ঘটনা কারোরই অজানা নয়। তাই বন অধিদপ্তরের অনিয়ম তদন্ত করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা এখন সময়ের সব বড় দাবি। অন্যথায় এসব অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধ করা যাবে না বরং নতুন নতুন আরো অনেক বনখেকোর জন্ম নেবে।