বিগত সরকার আমলে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জনের গল্প শোনালেও প্রকৃত পক্ষে দেশে দরিদ্র মানুষের হার বাড়ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে স্বল্প আয়ের অধিকাংশ পরিবার তাদের জীবন যাত্রার ব্যয় কমাতে বাধ্য হচ্ছে। কেউ বা ঋণ করে নিত্য দিনের ব্যয় নির্বাহ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের হাতে এখন নগদ টাকার উপস্থিতি বাড়ছে। আসলে মানুষের হাতে নগদ টাকার উপস্থিতি বাড়ছে না, তারা ব্যাংকে সঞ্চিত তাদের অর্থ উত্তোলন করে সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ করছে বলেই এমনটা হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার এ্যান্ড পাটিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক গবেষণা উল্লেখ করেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার বাড়াছে। বর্তমানে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হার ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে। এর মধ্যে অতি দরিদ্র মানুষের হার হচ্ছে ৯দশমিক ৩৫ শতাংশ। আরো অনেকেই আছেন যারা দারিদ্র্য সীমার সামান্য উপরে অবস্থান করছেন। সামান্য অভিঘাতেই তারা দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে আসতে পারেন। দারিদ্র্য বৃদ্ধির এই প্রবণতা যে কোন বিচারেই উদ্বেগজনক। তিন বছর আগেও দেশে দারিদ্রের হার কম ছিল। ২০২২ সালে সার্বিকভাবে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারি মানুষের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। সেই সময় অতি দরিদ্র মানুষের হার ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। দারিদ্র্য সীমার উপরে বসবাস করছে কিন্তু সামান্য অভিঘাতেই দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যেতে পারে এমন পরিবারের সংখ্যা হচ্ছে ১৮ শতাংশ। পিপিআরসি দেশের ৮ হাজার ৬৭টি পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ জন সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে এই জরিপ কার্য সম্পন্ন করে।

সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, ২০২৫ সালে পরিবারপ্রতি মাসিক জাতীয় আয় ছিল ৩২ হাজার ৬৮৫ টাকা। এর মধ্যে শহরে মাসিক আয় হচ্ছে পরিবার প্রতি ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকা এবং গ্রামে ২৯ হাজার ২০৫টাকা। পরিবারপ্রতি গড় জাতীয় ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৬১৫ টাকা এবং গ্রামীণ পর্যায়ে ২৭ হাজার ১৬২টাকা। মোট আয়ের ৫৫ শতাংশই চলে যায় খাবার ক্রয় করতে। মাসে একটি পরিবার গড়ে ১০ হাজার ৬১৪ টাকা ব্যয় করে খাবার ক্রয়ের জন্য। বিগত ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি ছিল। গত বছর জুলাই মাসে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ শতাংশ। এটা বিগত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির অভিঘাত একটি পরিবারের আর্থিক অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কর্মজীবীদের মধ্যে ছদ্ম বেকারের হার বাড়ছে। কর্মজীবীদের প্রায় ৩৮ শতাংশই পূর্ণঙ্গ কর্মসংস্থানে নেই। পিপিআরসি তাদের গবেষণায় উল্লেখ করেছে, গত তিন বছরে শহরের পরিবারগুলোর মাসিক আয় কমেছে কিন্তু ব্যয় বেড়েছে। ফলে দারিদ্র্যবস্থার উপর তা বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এক সময় যারা তুলনামূলক স্বচ্ছল অবস্থায় ছিলেন তারাও এখন দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে যাবার ঝুঁকিতে আছে। সংস্থাটি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করেছে, দেশে ৮০ শতাংশ পরিবার তাদের তাদের উপার্জন দিয়ে সংসারের খরচ বাবদ যে ব্যয় হয় তা পূরণ করতে পারছে না।

জনসংখ্যার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ পরিবারের মাসিক গড় আয় হচ্ছে ১৪ হাজার ৮৮১ টাকা। আর একই পরিবারের মাসে ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে ১৭ হাজার ৩৮৭ টাকা। মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকা ৪০ শতাংশ পরিবার গড়ে প্রতি মাসে আয় করে ২৮ হাজার ৮১৮টাকা। আর তাদের ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে ২৯ হাজার ৭২৭ টাকা। ৫২ শতাংশ পরিবার তাদের আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য কোন না কোনভাবে ঋণ গ্রহণ করছে। সবচেয়ে বিত্তবান ২০ শতাংশ পরিবার ভালো অবস্থায় রয়েছে। তাদের মাসিক আয় হচ্ছে গড়ে ৭৮ হাজার ৫০৩ টাকা। আর ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে ৭০ হাজার ৭৭০ টাকা। গত তিন বছর ধরে অভ্যন্তরীণ বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করায় অধিকাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে। তিন বছর ধরে মানুষের প্রকৃত আয় ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আয বাড়ছে না। যেমন ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। একই সময়ে মজুরির হার ছিল ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। একই বছর ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর মজুরির হার ছিল ৮দশমিক ১৪ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বৃদ্ধি না পাবার কারণে মানুষ সংসারের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে হিমসমি খাচ্ছে।