অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরি প্রদানের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান চাকরি প্রত্যাশিদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। বেকার সমস্যা নিরসনের জন্য সবচেয়ে উত্তম পন্থা হচ্ছে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে দেশের যুব সমাজকে কর্মমুখী করে গড়ে তোলা। বিশে^র উন্নত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষার হার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের মতো হলেও বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার হার ২০ শতাংশের নিচে। অনেকে বলেন, কারিগরি শিক্ষার হার বাস্তবে আরো অনেক কম। সূত্র মতে, দেশে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১২ হাজারের মতো। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকেরও বেশি আসন ফাঁকা রয়েছে অনেক দিন ধরেই। বিশে^র এমন দেশ নেই বললেই চলে যারা কারিগরি শিক্ষা বিস্তারের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পেরেছে। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা মোটেও কর্মমুখী নয়। আমাদের উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম আত্ম অহমিকাপূর্ণ বেকার তৈরি করছে মাত্র। কারিগরি শিক্ষার ওপর যতাযথ গুরুত্ব না দেবার কারণে দেশে বেকারের হার দ্রুত বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখের মতো। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, বেকারের সংখ্যা এবং হার নির্ধারণ করে থাকে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী কর্মক্ষম কোন ব্যক্তি যদি সপ্তাহে অন্তত এক ঘন্টা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করতে না পারেন তাহলে তিনি বেকার হিসেবে গণ্য হয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, উন্নত দেশগুলোতে কর্মহীন মানুষের জন্য বেকার ভাতাসহ নানা ধরনের সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। কাজেই আমাদের দেশের বাস্তবতার ভিত্তিতেই বেকারের সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। অর্থনীতির পরিভাষায় পূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান বলতে এমন একটি অবস্থাকে নির্দেশ করে যেখানে একজন কর্মজীবী তার উপার্জনের মাধ্যমে স্টান্ডার্ড অনুযায়ী ৫/৬ জন সদস্যের একটি পরিবারের ব্যয়ভার নির্বাহ করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে খুব কম চাকরি আছে যেখানে যুক্ত থেকে একজন ব্যক্তি তার ৫/৬ সদস্যের পরিবারের ব্যয়ভার নির্বাহ করতে পারছেন। অনেকেই আছেন যারা ছদ্ম বেকার। আবার কেউ বা আছেন আন্ডার এমপ্লয়েড। অর্থাৎ এরা কর্মে নিযুক্ত থেকেও আসলে বেকার।
প্রতিটি দেশের মতো বাংলাদেশও দারিদ্র্য বিমোচনকে অন্যতম জাতীয় ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের কর্মক্ষম মানুষের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা গেলে কোনভাবেই দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি প্রদানের মাধ্যমে কোনভাবেই বেকার সমস্যা দূরীকরণ সম্ভব নয়। বেকার সমস্যা সমাধানের একমাত্র সহজ পথ হতে পারে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। আত্মকর্মসংস্থানের জন্য কারিগরি শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। একজন মানুষ যদি উপযুক্ততা অনুযায়ী চাকরি না পেলে তিনি সহজেই আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজের বেকারত্ব নিরসন করতে পারেন। বাংলাদেশে বেকারে সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে উচ্চ শিক্ষিতদের মাঝে বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি তিনজন উচ্চ শিক্ষিতের মধ্যে একজন বেকার। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মমুখী নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বেকারের যে সংখ্যা এবং হার প্রদর্শন করছে তা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই কোন না কোনভাবেই বেকারের জ¦ালা বয়ে চলেছে। অনেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিয়োজিত আছেন কিন্তু উপযুক্ততা অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি প্রদানের মাধ্যমে কখনোই বেকার সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে না। এ জন্য আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
বেকার সমস্যা সমাধান করতে হলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবসম্মত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমিক স্তর থেকেই কারিগরি শিক্ষা গ্রহণকে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলে একজন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা লাভের পর কোন প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ততা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেলে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে। একজন উচ্চ শিক্ষিত অথবা মধ্যম মানের শিক্ষিত যুবক বা যুবতী যদি আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে নিজের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার পাশাপাশি অন্যদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন। শিক্ষা গ্রহণ পর্যায়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ পেলে তার মাঝে সংশ্লিষ্ট কাজের প্রতি সম্মান বোধ জাগ্রত হবে। তিনি সাধারণ কাজকেও অবহেলা বা ঘৃণা করবেন না। বর্তমান প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মমুখী তো নয়ই বরং কর্মবিমুখ। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।