যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারো রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে জয়লাভের পর তাঁর নীতিগত অবস্থান আবারো আমেরিকান ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’ দর্শনকে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে যে কঠোর বাণিজ্য নীতিমালার প্রচলন ঘটেছিল, তাতে আমদানিকৃত পণ্যের উপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ, বহুপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তি থেকে সরে আসা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একপাক্ষিকভাবে বাণিজ্যিক চাপে ফেলার প্রবণতা স্পষ্ট ছিল। এখন সে নীতির ধারাবাহিকতায় নতুন করে কর আরোপের যে হুমকি ট্রাম্প পুনরায় উত্থাপন করেছেন, তা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে উঠেছে।

ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নীতির মূল কথা হলো-যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি পণ্যের প্রবেশে উচ্চহারে শুল্ক আরোপ এবং চীনের ওপর নির্দিষ্টভাবে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কর বসানো। তাঁর দাবি, এতে করে আমেরিকান উৎপাদন শিল্প রক্ষা পাবে, কর্মসংস্থান বাড়বে এবং চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা সমাধান হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ জাতীয় কর নীতির প্রভাব শুধু চীন কিংবা ইউরোপ নয়, বরং সমগ্র তৃতীয় বিশ্বের ওপর পড়বেÑবিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ তৈরি করবে।

অনেক উন্নয়নশীল দেশই বর্তমানে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, লেদার গুডস, কৃষিপণ্য কিংবা প্রযুক্তি খাতে উৎপাদিত পণ্য আমেরিকায় রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশের মতো দেশ, যার বৈদেশিক আয়ের অন্যতম প্রধান উৎসই হলো তৈরি পোশাক শিল্প, তা যুক্তরাষ্ট্রে কর বৃদ্ধির ফলে ভয়াবহ প্রতিযোগিতামূলক সংকটে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে ইউরোপে জিইএসপি সুবিধার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে, তার মধ্যে যদি যুক্তরাষ্ট্রেও আমদানি বাধা আরোপ করা হয়, তবে রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিগুলো বড় রকমের ধাক্কা খাবে।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে, আমেরিকার শুল্কনীতি যদি পুনরায় ট্রাম্পের আদলে গড়ে ওঠে, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কর্মসংস্থান হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং দারিদ্র‍্য বৃদ্ধির মতো বহুমাত্রিক প্রভাব পড়বে। এ করনীতি শুধু সরাসরি রপ্তানি নয়, বরং বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের মধ্যে থাকা দেশগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তিনি নাফটা, টিপিপি কিংবা ডব্লিউটিও-এর মতো বহুপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি থেকে সরে এসে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই প্রবণতা বহুপাক্ষিক বাণিজ্য সংগঠন যেমন WTO-র সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বর্তমানে যদি একই ধরনের একপাক্ষিক নীতির পুনরাবৃত্তি ঘটে, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

এ সংকট থেকে উত্তরণে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যৌথভাবে কৌশলগত অবস্থান নিতে হবে। দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা জোরদার করতে হবে এবং নিজেদের বাজারের বহুমুখীকরণ প্রয়োজন। শুধুমাত্র আমেরিকা বা ইউরোপনির্ভর রপ্তানি কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

একইসঙ্গে আঞ্চলিক বাণিজ্যিক সংহতি বৃদ্ধি, উদীয়মান বাজার যেমন আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানির সুযোগ খোঁজা যেতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ও স্থানীয় শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো। বিশ্বায়নের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে হলে দেশগুলোর নিজস্ব উৎপাদন কাঠামোকে আধুনিকায়ন করতেই হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতির পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর আরোপের রাজনীতি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের চেষ্টা নয়, এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির ভারসাম্যকেও বিপন্ন করে তুলছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য এটি এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, বহুপাক্ষিক কূটনীতি এবং অর্থনৈতিক কৌশলের পুনর্বিন্যাস অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে, বিশ্বায়নের যে সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল, তা অনায়াসেই রূপ নিতে পারে বৈষম্যমূলক এক বাণিজ্যিক বিশ্বেÑযেখানে বিজয়ী হবে বড় অর্থনীতি, আর পরাজিত হবে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র জনগণ।